জুলাই অভ্যুত্থান, পাল্টে দেয় সব হিসাব-নিকাশ, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ ১৭ বছরের শাসনামলের অবসান ঘটে এই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে। শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন শুরু হলেও সরকারের দমন পীড়ন, হত্যা, নির্যাতনে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে। রাস্তায় নেমে আসে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা।
দীর্ঘ এক মাস আন্দোলন আর রক্তপাতের পর পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। জয়ী হয় ছাত্র-জনতা। দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্যহীন দেশের স্বপ্ন দেখা শুরু করে দেশের মানুষ।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের জেরে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার।
সেখানে বলা হয়, ৯ম গ্রেড (পূর্বতন ১ম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেড (পূর্বতন ২য় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। ওই পদসমূহে সরাসরি নিয়োগে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলো। ওই পরিপত্রের আগে পদগুলোতে নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০, নারী কোটা ১০, জেলা কোটা ১০, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ ও প্রতিবন্ধীদের ১ শতাংশ কোটা বহাল ছিল।
এই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ বাতিল চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাতজন ২০২১ সালে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন। তখন রুল জারির পর ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০২৪ সালের ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট।
রায়ে সরকারের পরিপত্র বাতিল করে কোটা বহাল রাখার আদেশ দেওয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রপক্ষ’ আবেদন করলে ৪ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে নিয়মিত আপিল করতে বলেন। ফলে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ ও আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে কোটা বহাল থাকে।
এরপর আন্দোলনে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা কোটা নিয়ে ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবি জানান। শুরুতে মিছিল, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি দিলেও সম্প্রতি শুরু হয় ‘বাংলা ব্লকেড’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করেন। এতে কার্যত অচল হয়ে পড়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক।
১১ জুলাই হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের প্রকাশিত রায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল করতে বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী, জাতিগত সংখ্যালঘু বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও অন্য জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও কোটা পদ্ধতি বজায় রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
রায়ের এ আদেশ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে কোটা পুনর্বহাল করতে বলেন হাইকোর্ট। তবে রায়ে বলা হয়, প্রয়োজনে সরকার কোটার অনুপাত বা শতাংশ কমাতে-বাড়াতে পারবে। কোটা পূরণ না হলে মেধা তালিকা থেকে কোটা পূরণের কথা বলা হয় রায়ে।
হাইকোর্টের এমন রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ৬ জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধনসহ সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার প্রতিবাদ করে৷ পরে ঈদের ছুটি শেষে শিক্ষার্থীরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করে৷ শিক্ষার্থীরা শাহবাগ অবরোধ, বাংলা ব্লকেডের মত কর্মসূচি দিতে থাকে৷ ততদিনে আন্দোলন সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে৷ এরপর সরকার ১৭ জুলাই হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ‑টু‑অ্যাপিল আবেদন করে। অবশেষে ২১ জুলাই বেশিরভাগ কোটা বাতিল করে এবং ৭ শতাংশ কোটা (মুক্তিযোদ্ধা ৫ শতাংশ,সংখ্যালঘু ও অন্যান্য ২ শতাংশ) রাখে।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কোটা পাবে না তো রাজাকারের নাতিপুতিরা কোটা পাবে?
তার এই মন্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিশেষ করে ১৫ জুলাই মধ্যরাতে আন্দোলনকারীরা এই বক্তব্যকে ঘিরে প্রতিবাদের নতুন স্লোগান শুরু করেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার-রাজাকার’ স্লোগান নিয়ে ক্যাম্পাসে মিছিল বের করে। এদিন শিক্ষার্থীরা আরও বেশি সংগঠিত হয়, যা জুলাই আন্দোলনে আরও বেগবান হয়।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ৷ কোটা সংস্কার আন্দোলনের সক্রিয় শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৬ জুলাই আন্দোলনরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন তিনি। এ ঘটনার পর সারাদেশের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। আন্দোলন আরও তীব্র হয়।
আন্দোলন চলাকালীন দেশব্যাপী যখন নির্বিচারে মানুষ হত্যা চলছিল তখন ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেখ হাসিনা সরকার ও তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগের এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
সেদিন ৬ আগস্ট সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ ঘোষণা করা হয়। এর একদিন পরে ৪ আগস্ট লং মার্চ একদিন আগে অর্থাৎ ৫ আগস্ট করার ঘোষণা আসে। ৫ আগস্ট ভোর থেকেই সারাদেশের মানুষ ঢাকা অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। অবশেষে ব্যাপক জনরোষে পড়ে সেদিনই শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান।
বাংলা৭১নিউজ/এবি
উপদেষ্টা সম্পাদক : সাখাওয়াত হোসেন বাদশা, প্রধান সম্পাদকঃ তাজিন মাহমুদ, সম্পাদক: ডা: সাদিয়া হোসেন, যোগাযোগঃ ৪/এ,ইন্দিরা রোড, মাহবুব প্লাজা (২য় তলা) ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, বাংলাদেশ ।মোবাইল: ০১৯৭১-১৯৩৯৩৪, ০১৫৫২-৩১৮৩৩৯, ই-মেইল: [email protected]; [email protected]। ওয়েব:www.bangla71news.com
© All rights reserved © 2018-2025