মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫, ০৭:০১ অপরাহ্ন

আজ পহেলা বৈশাখ: নব আঙ্গিকে-নব উৎসবে ঘিরে থাকবে দেশ

বাংলা৭১নিউজ,ঢাকা:
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২৫
  • ২৮ বার পড়া হয়েছে
ফাইল ছবি

‘তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে উড়ায়ে’ স্বৈরশাসকের পতনের পর তারই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে নতুন বছরে বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখবে একটি আলোকিত ভবিষ্যতের। শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জুলাই শহিদদের নিয়ে লেজার শো, মেলায় বর্ণবহুল হয়ে উঠবে নগরী। আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিকে অগ্নিস্নানে শূচি করে তুলতে আবার এসেছে বৈশাখ। শুভ নববর্ষ ১৪৩২। ‘দূরান্তের পলাতক বলাকার ঝাঁকে’ হারিয়ে গেল ১৪৩১।  বৈশাখের প্রতীক কৃষ্ণচূড়ার ডালেও লেগেছে আগুন। নতুনের আবাহনে কবিগুরুর সেই চিরায়ত সুর বাঙালির প্রাণে প্রাণে দ্যোতনা তুলবে : ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো হে . . . ।

গ্রীষ্মের অগ্নিজিহ্বা বাংলার বাতাসে ভূ-প্রকৃতিতে লকলক করে নেচে উঠবে। ঝড়বৃষ্টির দামামা বাজিয়ে, ধুলাবালির মেঘ উড়িয়ে, বজ্রের গর্জনে কাঁপিয়ে বৈশাখ অধিকার করে নেবে দশ দিক। বসন্তের সুধাভরা মদির রূপমাধুরীকে বিবর্ণ করে দিয়ে গ্রীষ্ম তার উদগ্র থাবা মেলে ধরবে আবার প্রকৃতিতে। প্রকৃতিতে জাগবে প্রলয় নাচন। বাতাস পাবে উদ্দামতা, প্রকৃতি হয়ে উঠবে রুক্ষ-রুদ্র-শুষ্ক-খর। আকাশে ঝলকাবে বিদ্যুত্বহ্নি, ঈশান-দুয়ার খুলে পশ্চিমা ঝড় দৈত্য সৈন্যের মতো ধেয়ে আসবে বাংলার জনপদে-বসতিতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়: বৈশাখে বিদ্যুৎ-চঞ্চুবিদ্ধ দিগন্তকে ছিনিয়ে নিতে আসা কালো শ্যেনপাখির মতো প্রলয়ংকরী ঝড় ধেয়ে আসবে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে নগরে-বন্দরে। এই গ্রীষ্মের অগ্নিবাণে প্রাণী, বৃক্ষ লতা গুল্ম, মৃত্তিকায় জাগে তৃষ্ণা। সেই আকুল নিদাঘ তিয়াষা ঘুচাতে বজ্রের রথে চেপে আসে প্রলয়ংকরী কালবৈশাখী। ঘন কৃষ্ণ মেঘরাশির গুরুগম্ভীর গর্জনে আকাশ যেন ভেঙে পড়ে জলপ্রপাতের ছন্দোময় বর্ষণ ধারায়। বাংলার প্রকৃতি আবার হয়ে উঠবে উর্বর সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা।

‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর /তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখীর ঝড়’…জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই সুর-ধ্বনির ভেতর দিয়েই বাঙালি নতুন বছরে সব অপ্রাপ্তি ভুলে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।

দুনিয়া কাঁপানো জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেড় দশকের দানবীয় স্বৈর সরকারের পতনের পর নব-পটভূমিতে আজ দেশের মানুষ উদযাপন করবেন বাংলা নববর্ষ। নব আঙ্গিকে-নব উৎসবে ঘিরে থাকবে দেশ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিজয়ের আবহেই এসেছে এবারের পহেলা বৈশাখ। চারদিকে উৎসবের রং, মুখে মুখে শুভেচ্ছা, কিন্তু এর মাঝে রয়েছে এক আশার বার্তা। আজ দিকে দিকে ছড়িয়ে যাবে-বদলে যাওয়ার, নতুন দেশ গড়ে তোলার বার্তা।

‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ বের করা হবে। শোভাযাত্রাটি চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসি মোড়, শহিদ মিনার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে পুনরায় চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হবে। নববর্ষের উৎসবকে সর্বজনীন করতে পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের চাপিয়ে দেওয়া ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’ নাম বদলে করা হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। শোভাযাত্রায় এ বছর ২৮টি জাতিগোষ্ঠী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন দেশের অতিথি অংশ নেবেন। এই বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় এ বছর থাকছে সাতটি বড়, সাতটি মাঝারি এবং সাতটি ছোট মোটিফ। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ‘স্বৈরাচারের প্রতিকৃতি’ নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের এক নেতা কর্তৃক পুড়িয়ে দেওয়ার পর নতুন করে চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নির্মাণ করেছেন ‘স্বৈরাচারের নব প্রতিকৃতি’।

আজ সরকারি ছুটির দিন। পত্র-পত্রিকা আজ প্রকাশ করেছে বিশেষ সংখ্যা। রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। সেই সঙ্গে আছে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নানা আয়োজন, ব্যবসায়ীদের হালখাতা।

কৃষির সঙ্গে বাংলা নববর্ষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এই সন প্রবর্তনের সূচনা থেকেই। আদিকাল থেকে এই আধুনিক যুগ পর্যন্ত কৃষিকাজের সঙ্গে ঋতুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। চিরকাল ঋতুর ওপর ভিত্তি করেই হয় ফসলের চাষাবাদ। মোগল সম্রাট আকবর প্রচলন করেন বাংলা সনের। এর আগে মোগল বাদশাহগণ রাজকাজে ও নথিপত্রে ব্যবহার করতেন হিজরি সন। হিজরি চান্দ্র বছর, যা ন্যূনধিক ৩৫৪ দিনে পূর্ণ হয়। কিন্তু সৌর বছর পূর্ণ হয় ন্যূনধিক ৩৬৫ দিনে। বছরে প্রায় ১১ দিনের পার্থক্য হওয়ায় হিজরি সন আবর্তিত হয় এবং ৩৩ বছরের মাথায় সৌর বছরের তুলনায় এক বছর বৃদ্ধি পায়। ফসল উৎপাদনের ঋতুর ভিত্তিতে কৃষকের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করতে হলে সারা দেশে একটি অভিন্ন সৌর বছরের প্রয়োজন। এই ধারণা থেকেই সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তার সিংহাসন আরোহণের সময় অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে। আকবরের নবরত্ন সভার আমির ফতেউল্লাহ খান সিরাজী বাংলা সন প্রবর্তনের কাজটি সম্পন্ন করেন। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন। পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। বৈশাখ নামটি নেওয়া হয়েছিল নক্ষত্র বিশাখার নাম থেকে। ‘বিশাখা হইতে নাম হইল বৈশাখ/আরম্ভিলা গ্রীষ্মকাল, প্রখর নিদাঘ/এই মাস হইতে বঙ্গে বর্ষ শুরু হয়/সিদ্ধিদাতা জগানন গণেশ কৃপায়’।

অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। চিরাচরিত এ অনুষ্ঠানটি আজও পালিত হয়। ক্রমান্বয়ে নববর্ষের ব্যাপ্তি আরও বিস্তৃত হয়। রূপান্তরিত হয় লোকজ উৎসবে। কালের বিবর্তনে নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরোনো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে, আবার সংযোগ ঘটেছে, অনেক নতুন উৎসবের। ১৯৬৫ সাল থেকে রমনার বটমূলে প্রতি বছর ছায়ানট বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালা নগরীতে নতুন তাৎপর্য পায়। এবারও বাংলা নববর্ষকে বরণের জন্য রমনা বটমূলে ছায়ানটের ‘এসো হে বৈশাখ’… অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকছে।

একে একে আরও অনেক সংগঠন প্রতি বছর নিয়মিতভাবে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। আধুনিক জীবন-পদ্ধতির নানা উপাচারের সমারোহে খেরো খাতায় হিসাব রাখার প্রচলন এখন উঠেই গেছে। তবু বাঙালির চিরায়ত উৎসবের দিন পহেলা বৈশাখে আজ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত হবে হালখাতা। মিষ্টি মুখ করানো হবে ক্রেতাদের। তমসা থেকে জ্যোতিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পটভূমিতে সূচনা হলো আরও একটি বর্ষযাত্রা। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশবাসীকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2018-2025
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com