বাংলা৭১নিউজ,ডেস্ক: টেবিলের ওপাশে হোমরাচোমরা সব তালেবান নেতা। এপাশে আফগান নারী ফওজিয়া কুফি। তালেবান নেতাদের চোখে চোখ রেখে সাফ জানালেন, নারীরা ঘরে বন্দী থাকবে না। নারীর অধিকার রয়েছে মুক্ত পৃথিবীতে নিজের জায়গা করে নেওয়ার। সাহসী ফওজিয়া দৃপ্তকণ্ঠে বলেন, ‘তোমাদের পছন্দ হোক বা না হোক, আমি আমার মতো। চলব নিজের মতোই।’
রাশিয়ার মস্কোর ওই আলোচনার টেবিলে ৪৮ জন পুরুষ। দুজন নারী। তাঁদেরই একজন ফওজিয়া। সোচ্চার ফওজিয়া জানিয়েছেন নিজের জোরালো অবস্থান। বলেছেন, যেকোনো পদে দায়িত্ব পালনের জন্য নারীরা যোগ্য। নারী আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হতেই পারেন। কারণ দেশের সংবিধানে সে সুযোগ আছে। তালেবান জঙ্গিদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে এখানে মূল্যহীন।
ফওজিয়া আফগানিস্তানের পার্লামেন্টের প্রথম নারী ডেপুটি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নারী অধিকার রক্ষায় কাজ করেন। পার্লামেন্টের বাঘা বাঘা সব পুরুষ সদস্য ফওজিয়ার কর্মকাণ্ডে খুব বেশি খুশি ছিলেন না। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় খুব বেশি সায় ছিল না তাঁদের। তবে ফওজিয়া দমেননি। তিনি জানতেন, সবাইকে খুশি করা যায় না। নারী বলে তাঁকে অনেক ক্ষেত্রেই দমিয়ে রাখার চেষ্টা চলেছে। এই অবস্থানে আসতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে ফওজিয়াকে সবার পেছনে জায়গা দেওয়া হতো। বিদেশি গণমাধ্যমে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হতো না। আফগানিস্তানের রক্ষণশীল সমাজে জন্মের পর থেকে বাঁচার লড়াই করছেন ফওজিয়া। লড়াই–ই তাঁর জীবন।
মেয়ে হয়ে জন্মানোয় সৎমা ফওজিয়াকে সারা দিন কড়া রোদে ফেলে রেখেছিলেন। সৎমা চেয়েছিলেন—ফওজিয়া মরে যান। তাঁর বাবার সাত স্ত্রীর একজন ছিলেন তিনি। পরিবারের ২৩ সন্তানের মধ্যে ফওজিয়া একজন। সেদিন ছোট্ট ফওজিয়ার তুলতুলে নরম শরীরটা প্রখর রোদে পুড়ছিল। হয়তো পুড়তে পুড়তেই শক্ত হচ্ছিল। জন্মদাত্রী মা ফওজিয়াকে দেখতে পান। রোদ থেকে ছায়ায় নিয়ে যান। সেদিন থেকেই মায়ের ছায়ায় শুরু হয় ফওজিয়ার লড়াই। ফওজিয়াই পরিবারের প্রথম মেয়ে সন্তান, যিনি স্কুলে গিয়েছিলেন। পড়াশোনা ভালোই চলছিল। ১৯৯৬ সালে তালেবান সরকার জোর করে ফওজিয়ার মেডিকেল কলেজে পড়া বন্ধ করে দেয়।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী তালেবান জঙ্গি দমন অভিযান শুরু করে। একপর্যায়ে ফওজিয়া ইউনিসেফে কাজ শুরু করেন। ২০০৫ সালে রাজনীতিতে ঢোকেন। পার্লামেন্টে তিনিই প্রথম নারী ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।
তালেবান নেতাদের হুমকি–ধামকি অবশ্য বন্ধ হয়নি। তালেবান জঙ্গিরা তাঁর স্বামীকে কারাবন্দী করেছে। পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার পর ফওজিয়াকে তালেবানরা মেরে ফেলতে চেয়েছে। নারী অধিকার নিয়ে ফওজিয়ার সরব হওয়াটাই তাঁদের ক্ষোভের কারণ।
ফওজিয়াকে সেই ভয়ংকর শত্রুদেরই মুখোমুখি হতে হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে মস্কোয় বিলাসবহুল একটি হোটেলে তালেবান জঙ্গিদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় একজন ছিলেন তিনি। সুযোগটা পেয়েই ফওজিয়ার মনে হয়েছিল, তালেবানদের বুঝিয়ে দিতে হবে তাদের নারীবিদ্বেষ আর আফগানিস্তানে শিকড় গাড়তে পারবে না।
কাবুলে নিজের বাড়িতে এএফপিকে এক সাক্ষাৎকারে ফওজিয়া বলেন, আফগানিস্তানের নারীদের জন্য কাজটি জরুরি ছিল। তালেবানদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে ক্ষমতাবান মনে হচ্ছিল।
ওজিয়া তালেবান জঙ্গিদের বলেন, তোমরা আমার মেয়েকে বাড়িতে আটকে রাখতে পারো না। পৃথিবীকে দেখার, চেনার জানালা তোমরা বন্ধ করে দিতে পারো না। আমার মেয়ের এখন বাইরের জগতের সঙ্গে অনেক বেশি যোগাযোগ রয়েছে। তোমরা তাঁকে তোমাদের সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারো না।
তালেবান জঙ্গিদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার একটি অংশ হিসেবে মস্কোতে ওই আলোচনা হয়। গত সোমবার দোহায় তালেবান জঙ্গিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে ওয়াশিংটন। দীর্ঘদিন ধরে চলা সহিংসতার অবসান খোঁজা হচ্ছে ওই আলোচনায়। তবে আফগানিস্তানের সাধারণ জনগণসহ অনেক পর্যবেক্ষকের ভয়, যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা দ্রুত চলে গেলে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ বেধে যেতে পারে। তালেবানরা আবার ক্ষমতায় আসতে পারে।
তালেবান শাসনে ফিরতে ভয় পান আফগানিস্তানের নারীরা। তাঁদের ভয়, এতে আবার জীবন অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে। শিক্ষাক্ষেত্রে বা কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সুযোগ হারাবেন। মস্কোর ওই আলোচনায় এসব কথাই জোর দিয়ে বলেছিলেন ফওজিয়া।
ফওজিয়া এক মজার অভিজ্ঞতাও বলেন। মস্কো যাওয়ার পথে উড়োজাহাজে তাঁর সহযাত্রী ছিলেন তালেবান এক পুলিশ। তালেবান সরকারের ওই পুলিশ হিলাক্স পিকআপ গাড়িতে ঘুরে বেড়াতেন। যখন–তখন অশালীনতার অভিযোগ আনতেন নারীদের বিরুদ্ধে। তাঁদের মারধর করতেন। তালেবান ওই পুলিশকে সে কথা মনে করিয়ে দেন ফওজিয়া। বলেন, ‘সে সময়টা কতটা ভয়ংকর আমি মনে করতে পারি। গাড়ির শব্দ এখনো আমার কানে বাজে। আমি আমার মতো। তুমি পছন্দ করো বা না করো, আমি বদলাব না।’
বাংলা৭১নিউজ/প্রথম আলোর সৌজন্যে