বাংলা৭১নিউজ,ঢাকা: পতনের ধারা কাটিয়ে ‘চাঙাভাব’ দেখা দিয়েছে দেশের পুঁজিবাজারে। প্রতিদিনই লেনদেন হওয়া সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার পাশাপাশি উলম্ফন ঘটছে মূল্য সূচকে। সেই সঙ্গে লেনদেনেও দেখা দিয়েছে তেজিভাব। ফলে পুঁজিবাজার নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
বড় ধরনের রাজনৈতিক হানাহানি ছাড়াই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া এবং সরকারের ধারাবাহিকতা থাকায় পুঁজিবাজার পতনের ধারা কাটিয়ে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা। তবে বাজারের চাঙাভাব এবং লেনদেনের তেজিভাবের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী পরিবর্তন হওয়া ‘টনিক’ হিসেবে কাজ করেছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
তারা বলছেন, সদ্য সাবেক হওয়া বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দায়িত্ব থাকা অবস্থায় পুঁজিবাজার নিয়ে নানা নেতিবাচক মন্তব্য করেন। তিনি (মুহিত) কখনও পুঁজিবাজারকে ‘জুয়া খেলা’ আবার কখনও ‘ফটকা বাজার’ বলেও অভিহিত করেন। অর্থমন্ত্রীর এমন ‘বেফাঁস কথা’র কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাজারের ওপর। ফলে বিনিয়োগকারীদের বেশির ভাগই আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওপর নাখোশ ছিলেন।
তাদের মতে, নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যেমন মেধাবী, তেমনি অভিজ্ঞ। কথা-বার্তাতেও সংযত। পুঁজিবাজার সম্পর্কেও তার যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে। সুতরাং আগের অর্থমন্ত্রীর মতো তিনি বাজার নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করবেন না। এ কারণে নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রতি বিনিয়োগকারীদের এক ধরনের আস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। এরই বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে বর্তমান পুঁজিবাজারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে যে ঊর্ধ্বমুখিতা দেখা দিয়েছে তা খুবই ভালো লক্ষণ এবং প্রত্যাশিত ছিল। তবে এ বাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিচক্ষণতার সঙ্গে বিনিয়োগ করতে হবে। কোনো কোম্পানিতে বিয়োগের ক্ষেত্রে সেই কোম্পানির সার্বিক তথ্য পর্যালোচনা করতে হবে। সেই সঙ্গে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার নিয়ে যাতে কোনো চক্র ফায়দা লুটতে না পারে সে জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করার পদক্ষেপ নিয়ে শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে হবে।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ সালের শুরুর দিকে পুঁজিবাজারে মূল্য সূচকে তেজিভাব দেখা যায়। তবে লেনদেনের গতি ছিল কম। আর বছরটির প্রথম চার মাস পার হতেই লেনদেনের পাশাপাশি মূল্য সূচকেও নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যায়। নির্বাচনের বছর হওয়ায় সেই নেতিবাচক প্রবণতা বছরের প্রায় সময়জুড়ে অব্যাহত থাকে। তবে নির্বাচনের আগের সপ্তাহে হঠাৎ করেই টানা ঊর্ধ্বমুখিতার দেখা মেলে। কিন্তু লেনদেনের গতি ছিল কম।
এ পরিস্থিতিতে এক প্রকার শঙ্কার মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। নির্বাচনের পরের কার্যদিবসেই উলম্ফন দেখা যায় মূল্য সূচকে। তার পরের কার্যদিবসে সূচকের বড় উত্থানের পাশাপাশি গতি আসে লেনদেনেও। ফলে নির্বাচনের পর প্রথম ছয় কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক বেড়েছে ৩৮৫ পয়েন্ট।
এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিতের পরিবর্তে আ হ ম মুস্তফা কামালের নাম ঘোষণা আসার দিন ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স বাড়ে ৯৭ পয়েন্ট। নতুন অর্থমন্ত্রীর শপথ নেয়ার পরের কার্যদিবসে সূচক বেড়েছে ১১৭ পয়েন্ট, যা গত দশ মাসের মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ উত্থান। সূচকের বড় উত্থানের সঙ্গে লেনদেন পৌঁছে গেছে হাজার কোটি টাকার ঘরে।
ডিএসইর এক সদস্য বলেন, রাজনৈতিক হানাহানি ছাড়া নির্বাচন হওয়া এবং সরকারের ধারাবাহিকতা দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক। এর সঙ্গে অর্থমন্ত্রী পরিবর্তন হওয়া পুঁজিবাজারের জন্য সব থেকে ভালো সংবাদ। কারণ আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকলে কখন কী বলে ফেলেন তার ঠিক নেই। তিনি হয়তো হঠাৎ এমন মন্তব্য করে ফেলতেন যে, ভালো বাজারও খারাপ হয়ে যেত। অতীতে অনেকবার এমন ঘটনা ঘটেছে।
তিনি আরও বলেন, পুঁজিবাজার খুবই সেনসেটিভ (স্পর্শকাতর)। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যেকোনো মন্তব্যে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, আবার মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাবও পড়তে পারে। আমরা আশা করছি নতুন অর্থমন্ত্রী পুঁজিবাজার নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করবেন না। বরং বাজারের উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে ভূমিকা রাখবেন। পুঁজিবাজারের ওপর নতুন অর্থমন্ত্রীর যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন হওয়ায় পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন অদূর ভবিষ্যতে অর্থনীতিতে চাপ আসবে না। অর্থনীতি একটি স্বস্তিকর পরিবেশে আছে। সমস্যা আছে শুধু ব্যাংক খাতে। ব্যাংকের পিই রেশিও (মূল্য আয় অনুপাত) যথেষ্ট কম। সুতরাং এ খাতে বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ আছে।’
তিনি বলেন, ‘টানা উত্থানের কারণে বাজার যে অবস্থায় এসেছে তাতে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। তবে দেখতে হবে বাজারে কারসাজি আছে কিনা এবং খারাপ শেয়ারের দাম বাড়ছে কিনা। সেই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে বাজারে যাতে ২০১০ সালের মতো আবার বুদবুদ সৃষ্টি না হয়।’
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক এ চেয়ারম্যান বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এ ঊর্ধ্বমুখী বাজারে বিনিয়োগকারীদের বাছ-বিচার করে বিনিয়োগ করতে হবে। কোম্পানির আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখে বিনিয়োগ করতে হবে। জেড গ্রুপের শেয়ার কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে।’
অর্থমন্ত্রী পরিবর্তনের সঙ্গে পুঁজিবাজারে কোনো প্রভাব আছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী পরিবর্তনের কারণে পুঁজিবাজারে খুব বড় ধরনের ভূমিকা আছে কিনা এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাজারে যে উত্থান হয়েছে তা স্বাভাবিক। অর্থমন্ত্রী পরিবর্তন হয়েছে, নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে; এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। এছাড়া ২০১৯ সালে বাংলাদেশের ক্যাপিটাল ফ্লো বাড়বে। আর্থিক খাতে যে সঙ্কট ছিল তা অনেকখানি লাঘব হবে। অর্থমন্ত্রী পরিবর্তন মানুষের মধ্যে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার চ্যালেঞ্জ হবে বাজারকে কুলডাউন করা। সরবরাহ ব্যবস্থাকে ফ্লেক্সিবল করা, নতুন নতুন শেয়ার নিয়ে আসা। যাতে বিনিয়োগকারীদের চাহিদা পূরণ করা যায়। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের হুজুগে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং কোম্পানি দেখে বিনিয়োগ করতে হবে। কিছুতেই জাঙ্ক বা বাজে কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা ঠিক হবে না।’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচনের পর সরকারের ধারাবাহিকতার একটি প্রতিফলন বাজারে পড়ছে এবং অংশগ্রহণ বাড়ছে। আমি বাজারের বর্তমান চিত্রকে পজেটিভভাবে দেখছি। এটাকে ধরে রাখতে হবে। এজন্য ভালো ভালো শেয়ার আনতে হবে। সেই সঙ্গে আজেবাজে শেয়ার নিয়ে খেলাধুলা করা শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মৌলিক শেয়ারে বিনিয়োগ করতে হবে। মৌলিক শেয়ারে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকারীরা ঠকবেন না।’
বাংলা৭১নিউজ/জেড এইচ