বাংলা৭১নিউজ,ডেস্ক: দায়িত্ব পাওয়ার পর একজন মন্ত্রীর মাথায় ভিড় করে বহুমূখী কাজের পরিকল্পনা। বিবেচনায় আসে মন্ত্রণালয়ের কাজের পরিধি। কী করবেন, কতটা ভালোভাবে করবেন, কোন কোন ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনবেন, কীভাবে আরো বেশি দক্ষতার প্রমাণ দেবেন- ইত্যাদি ভাবনা তিনি ভাবেন। আমি মনে করি, অন্যান্যদের মতোই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রীও এখন এমনটাই ভাবছেন। তার ভাবনার সঙ্গে আমি আরো কিছু বিষয় যোগ করতে চাই। নতুন সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রীর বিশেষ নজর চাই উপকূলের দিকে। এই লক্ষ্যে তার সমীপে উপকূলবাসীর পক্ষ থেকে রাখছি ১৭ দফা। আশা করছি তিনি বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন।
সরকারের এতগুলো মন্ত্রণালয় থাকতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে উপকূলবাসীর কেন এই আর্জি? প্রশ্ন আসাটা খুব স্বাভাবিক। জবাবে বলা যায়- এই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে উপকূলবাসীর অস্তিত্ব জড়িত। তাদের ভালো থাকা, নিরাপদে থাকা নির্ভর করে এই মন্ত্রণালয়ের ওপর। যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই মন্ত্রণালয় উপকূলবাসীর সুরক্ষা দিতে পারে। নতুন মন্ত্রীসভায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পূর্নমন্ত্রীর দায়িত্বে কেউ আসেননি। প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন ঢাকা-১৯ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ডা. এনামুর রহমান। তাই শুরুতেই উপকূলবাসীর দাবিটা তার কাছে তুলতে চাই। তার আগে উপকূলবাসীর পক্ষ থেকে তাকে জানাতে চাই প্রাণঢালা অভিনন্দন।
সংজ্ঞার নিরিখে বাংলাদেশের দক্ষিণে সমুদ্ররেখা বরাবর ১৯ জেলা উপকূলীয় জেলা হিসেবে চিহ্নিত। ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস, লবণাক্ততার প্রভাব ও জোয়ার ভাটার বিস্তৃতির ওপর ভিত্তি করে জেলাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। জেলাগুলোর মধ্যে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ভোলা, ঝালকাঠি, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কম ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে যশোর, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ। পরিধি হিসাবে উপকূলীয় অঞ্চল অনেক বড় এলাকা। এখানে প্রায় ৫ কোটি লোকের বসবাস। এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ বিভিন্ন ধরণের দুর্যোগের শিকার হয় প্রতিবছর। কর্মসংস্থানসহ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ে। দুর্যোগের কারণে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মানুষের ছুটে চলার অনেক ঘটনার সাক্ষী আমি নিজেই। কিন্তু এদের পুনর্বাসনে যেসব উদ্যোগ রয়েছে, তা সীমিত।
আমরা লক্ষ্য করেছি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র জরুরি ব্যবস্থাপনার দিকেই বেশি নজর দেওয়া হয়। বিগত বছরগুলোতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এরইমধ্যে বিশ্ব দরবারে ব্যাপক প্রশংসাও কুড়িয়েছে। কিন্তু নীরবে যে নানামূখী প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলের মানুষের জীবন ওলটপালট করে দিচ্ছে, সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে খুব কম। নদীর ভাঙন প্রতিবছর উপকূলের বহু মানুষকে পথে বসিয়ে দেয়। লবণাক্ততার প্রভাবে কত মানুষ যে বিপদগ্রস্থ, তার খবর কে রাখে? যে কৃষক জমিতে হালচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তার জমি এখন আর ফসল দেয় না। ফসলি জমিতে ছড়িয়ে পড়েছে লবণের বিষ। নাজুক বেড়িবাঁধ উপকূলের অনেক স্থানের মানুষকে আতংকে রাখে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভূমি হারানো বহু মানুষকে আমি চিনি, যারা উপকূলে কোনমতে মাথা গুঁজে আছেন, নতুবা পাড়ি জমিয়েছেন শহরে। নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারীদের ওপরও পড়েছে বৈরি প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব। সংকুচিত হয়েছে মাছ ধরার স্থান ও সময়। দুর্যোগের মাত্রা বাড়ার কারণে মাছধরার সময় কমেছে। সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে উপকূলবাসীর তাই অনেক প্রত্যাশা। উপকূল অঞ্চলের প্রধান দুর্যোগ হিসাবে ধরা হয় ঘূর্ণিঝড়কে। কিন্তু অনেক ছোট বিষয় রয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে এখনও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যালের খবর পেয়ে উপকূলের মানুষগুলো কেন আশ্রয়কেন্দ্রে যান না? জানতে চাইলে উপকূলের প্রান্তিকের মানুষের পাল্টা প্রশ্ন- ‘আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে আমার ঘরের মালামাল কে দেখে রাখবে? পানি বাড়লে গরু-ছাগলের রশি কে কেটে দিবে?’ কেউবা প্রশ্ন তোলেন- ‘আশ্রয়কেন্দ্রে কেমনে থাকবো? সেখানে থাকার পরিবেশ আছে? টয়লেট আছে? পানি আছে?’ এই পাল্টা প্রশ্নের জবাব আমাদের কাছে নেই। কারণ, সমগ্র উপকূল ঘুরে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতির ক্ষেত্রে যেসব ত্রুটি রয়েছে; ওদের এই প্রশ্নগুলো সেইসব ত্রুটিকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
ঘূর্ণিঝড় সিডর-আইলা থেকে শুরু রোয়ানু, মোরা, মহাসেন, রেশমীসহ অধিকাংশ ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যালের পর একই চিত্র ভেসে ওঠে। কখনো শুনি, সতর্কীকরণ বার্তা মানুষের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছেনি। কখনো শুনি, অবস্থার সাথে মিল রেখে সতর্কবার্তা দেয়া হয়নি। কখনো শুনি, আকস্মিকভাবে অবস্থার অবনতি হওয়ায় মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেনি। আবার কখনো শোনা যায়, সতর্কীকরণ বার্তা উপেক্ষা করেছেন মানুষ। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে ঘুরেফিরে একই চিত্র আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় মোরা’র অভিজ্ঞতাও আমাদের সেকথাগুলোই আবার মনে করিয়ে দেয়। তথ্যশূন্যতা, মানুষের অসচেতনতা, আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে অনীহা, সিগন্যাল বিভ্রান্তি ইত্যাকার নানান বিষয় আমাদের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতির দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বারবার।
উপকূলের প্রান্তিক জনপদের মানুষের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে অনীহা চিরাচরিত। শখের হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু এবং অন্যান্য সম্পদ ছেড়ে তারা অন্য কোথাও যেতে চান না। অনেককে বলতে শুনেছি- অন্তত একজনকে থাকতে হবে। কারণ পানি বাড়লে গবাদি পশুর বাঁধন কে খুলে দেবে? আবার আশ্রয়কেন্দ্রে যারা যাচ্ছেন, তারাও নানামূখী ঝামেলায় পড়েন। আশ্রয়কেন্দ্র তালাবদ্ধ থাকার কথা শুনে আসছি সেই কবে থেকে। গতবছর ‘মোরা’র ক্ষেত্রেও সেটা ছিল কোথাও কোথাও। অনেক স্থানে প্রয়োজনীয়সংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও সেখানে যাওয়ার রাস্তা ভালো নয়। অধিকাংশ স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র থাকার পরিবেশ নেই ইত্যাদি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আজও নারীবান্ধব করা যায়নি। দুর্যোগের আগে, দুর্যোগের কালে এবং দুর্যোগের পরে নারীদের বিপদাপন্নতার কথা শোনা যায়।
ঘূর্ণিঝড় সিগন্যালিং ব্যবস্থায় কিছু সমস্যা আজও রয়ে গেছে বলে অনেকে মনে করেন। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় মোরা (৩০ মে, ২০১৭) আঘাতের সময় মানুষের আশ্রয়কেন্দ্রে না যাওয়ার বিষয়টিকে অনেকে সিগন্যালিং ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। যখন ৮ কিংবা ১০ নম্বর সিগন্যাল ঘোষণা করা হয়েছে, তখন সেরকম কোন পরিবেশ বাসিন্দারা লক্ষ্য করেননি। আমাকে অনেকে বলেছেন, পানিও বাড়েনি, বাতাসও নেই। সুতরাং আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন কী? ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি বিষয়ে লক্ষ্মীপুরের রামগতির দ্বীপ ইউনিয়ন চর আব্দুল্লাহ’র চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মঞ্জু আমাকে জানালেন, ইউনিয়নের প্রায় ১৪ হাজার মানুষের মধ্য থেকে তিনি মাত্র ১৩০ জনকে নৌকায় করে এপারে আনতে সক্ষম হয়েছেন। বাকিরা তাদের সম্পদ গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, বাড়িঘর রেখে আসতে চান না। এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত ঘোষণা করা হলেও ওই দ্বীপে পানিও বাড়েনি; বাতাসের গতিবেগও একেবারেই স্বাভাবিক।
ঘূর্ণিঝড় মোরা’র ওই রাতে প্রায় গোটা উপকূলে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার এবং মহেশখালী বাদে প্রায় সকল স্থানের অবস্থা গভীর রাত পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। সিগন্যালে কোন সমস্যা ছিল কিনা- বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা বলতে পারবেন। তবে বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, ঘূর্ণিঝড় উৎপত্তির অনেক পরে মানুষকে জানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এবং হঠাৎ করেই সিগন্যাল উচ্চ মাত্রায় চলে গেছে। কোনোভাবেই আমি নিজেকে বোঝাতে পারি না, উৎপত্তিস্থল থেকে আমরা কেন ঘূর্ণিঝড়ের খবর মানুষকে জানাতে পারছি না? এটা কী আমাদের কৌশলের ভুল, নাকি প্রযুক্তিগত সমস্য? বিভিন্ন সময়ে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, শত চেষ্টার পরেও ঘূর্ণিঝড় সময়ে উপকূলের একেবারে প্রান্তিকের সব খবর কেন্দ্রে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। বিশেষ করে চর কিংবা দ্বীপাঞ্চলে গণমাধ্যমকর্মীদের যাওয়া দুরূহ ব্যাপার। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সড়ক পথে যেখানে যাওয়া সম্ভব সেখান থেকেই টেলিভিশন লাইভ প্রতিবেদন দেখানো হয়। ঝড়ের সময় অধিকাংশ চরের, দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সেখানকার বিপদের খবরগুলো তাৎক্ষণিক জানা সম্ভব হয় না। পরে হয়তো সব খবর জানা যায়, কিন্তু তাৎক্ষণিক খবরাখবর পাওয়ার বিষয়টি জরুরি।
আশ্রয়কেন্দ্রে না যাওয়া প্রসঙ্গে উপকূলবাসীর পাল্টা প্রশ্নের যে কথা উল্লেখ করা হলো, সে প্রশ্নগুলো আসলে আমারও। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরে ক্ষতবিক্ষত জনপদ বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে শুরু করে মহেশখালী, কুতুবদিয়া, ভোলার বিভিন্ন চরাঞ্চলের উদাহরণ তুলে বলা যায়, অধিকাংশ স্থানে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পরিবেশ আসলেই নেই। অনেক স্থানে ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ বিষয়ে মানুষের স্পষ্ট ধারণা থাকলেও ঘূর্ণিঝড়ে যাওয়ার রাস্তাটি পর্যন্ত ঠিকঠাক নেই। আবার আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা কম হওয়ায় অতিরিক্ত মানুষদের থাকতে হয় গাদাগাদি করে। আবার সম্পদ রক্ষার প্রশ্ন তো আছেই। এত বলার পরেও এখন পর্যন্ত উপকূল অঞ্চলে পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়নি। অন্যদিকে কোন কোন এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে।
উপকূলের অনেক স্থানে বেড়িবাঁধ খুবই নাজুক। শক্ত বেড়িবাঁধ না থাকায় ছোট ধাক্কাতেই অনেক স্থানে বড় ক্ষতি হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু’র (২১ মে, ২০১৬) ক্ষেত্রে সেটাই প্রমাণিত। ওই ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রামের বাঁশখালীর খানখানাবাদ, ছনুয়া, কুতুবদিয়ার উত্তর ধূরুং এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। এসব এলাকা ঘুরে আমি জানতে পারি, বেড়িবাঁধ না থাকায় অথবা নাজুক থাকায় ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত এখানে এসে প্রবল হয়েছে। এইসব এলাকার মানুষেরা দুই বছরেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়ে। কোথাও বাড়িঘর মাটির সাথে মিশে যায়। অনেকে জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ট্রলারখানি হারিয়ে পথে বসেছেন। উপকূলের ঝুঁকিপূর্ন জনপদ কক্সবাজারের মহেশখালীর ধলঘাটা, কুতুবদিয়ার উত্তর ধূরুং, তাবালরচর, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, চট্টগ্রামের বাঁশখালীর খানখানাবাদ, ছনুয়া, সন্দ্বীপের রহমতপুর, হরিশপুর, বাংলাবাজার, লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের লুধুয়া, মতিরহাট, ভোলার ভবানীপুর, ইলিশা, তজুমদ্দিন, নোয়াখালীর হাতিয়ার নলচিরা, সুখচরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছি উপকূলের বেড়িবাঁধের অবস্থা একেবারেই নাজুক। অনেক স্থানে বেড়িবাঁধই নেই। বড় ঝাপটার প্রয়োজন নেই, ছোট আঘাতই এই বাঁধ ভেঙ্গে দিতে পারে। এবং বারবার ঘূর্ণিঝড়ে তা দিচ্ছেও। প্রশ্ন হলো, এ বিষয়গুলো জেনেও আমরা কী পদক্ষেপ নিচ্ছি?
উপকূলে সংবাদমাধ্যমের নিবিড় নজরদারির কথা আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি। সংবাদমাধ্যম কেন শুধু জরুরি সময়ে আসবে? ঘূর্ণিঝড়ের বাইরে উপকূলে কী আর কোনো খবর নেই। এই যে আশ্রয়কেন্দ্রের কথা বলছি, বাঁধের কথা বলছি, সিগন্যালিং কিংবা সচেতনতার কথা বলছি; এগুলো নিয়ে তো বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন প্রকাশের কিংবা প্রচারের সুযোগ আছে। উপকূলের এইসব খবরাখবর যে একেবারেই প্রচারমাধ্যমে আসছে না, তা নয়। তবে মাত্রাটা আরও বাড়ানো দরকার। ফলে মানুষ সচেতন হতে পারে। অসংলগ্নতাগুলো দূর হতে পারে। ফলে হয়তো আমরা বিশেষ সময়ে অর্থাৎ ঘূর্ণিঝড় এলে রক্ষা পেতে পারি। এভাবে সংবাদমাধ্যম উপকূলের সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী মহলকেও উপকূলের দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে।
উপকূল সুরক্ষায় ১৭টি বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি। বিষয়গুলো হচ্ছে: ১) জনসংখ্যা অনুপাতে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে; ২) আশ্রয়কেন্দ্রের যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে; ৩) আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে হবে; ৪) আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সড়ক ভালো থাকতে হবে; ৫) সতর্ক সংকেত বিষয়ে মানুষদের আরও সচেতন করতে হবে; ৬) আবহাওয়ার সঙ্গে মিল রেখে যথাযথ সংকেত দিতে হবে; ৭) শক্ত ও উঁচু বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে; ৮) মাঠ পর্যায়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিকে আরও আগে থেকে সক্রিয় হতে হবে; ৯) উৎপত্তিস্থল থেকে ঘূর্ণিঝড় সংকেত জানানো শুরু করতে হবে; ১০) উপকূলের সব মানুষকে রেডিও নেটওয়ার্ক-এর আওতায় আনতে হবে; ১১) সংবাদমাধ্যমকে সারাবছর উপকূলে নজরদারি রাখতে হবে; ১২) উপকূল অঞ্চলের দুর্যোগ রিপোর্টিংয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে; ১৩) জরুরি সময়ে দ্বীপ-চরের তথ্য আদান প্রদানে তথ্য নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে; ১৪) দুর্যোগ বিষয়ক তথ্যকেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে; ১৫) নারীবান্ধব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে; ১৬) দুর্যোগে বাস্তুচ্যুত মানুষের টেকসই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে হবে; এবং ১৭) বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংকট উত্তরণে ব্যবস্থা নিতে হবে। দাবিগুলোর মধ্যে কিছু পুরানো দাবি আছে, আবার কিছু নতুন দাবিও রয়েছে। সমস্যা সমাধান করতে হলে সবগুলো দাবি বাস্তবায়নে নজর দিতে হবে।
আমরা জানি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সফলতার সুনাম বিশ্বজুড়ে। তবুও ভালোর তো শেষ নেই। বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ন থাকুক; আর উপকূলের মানুষগুলোও ভালো থাকুক, নিরাপদে থাকুক। ত্রুটিমুক্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মডেল গড়ে উঠুক বাংলাদেশে। আর সেই ত্রুটি দূর করতে হলে যারা ভুগছে; সেই উপকূলবাসীর সাথেই কথা বলতে হবে। উপকূলের মানুষের কথা শুনুন; তাদের কণ্ঠস্বর প্রাধান্য দিন। যাদের সমস্যা সমাধানের কথা, তাদেরকেই বলতে দিন। তবেই উপকূলবাসী আর পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়বে না।
বাংলা৭১নিউজ/জেড এইচ