বাংলা৭১নিউজ,ডেস্ক: বাংলাদেশে সম্প্রতি ফেসবুকে দু’জন নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করে একাধিক পোস্ট দেয়ার পর এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।তাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনাকে বিশ্বজুড়ে চলমান মি-টু আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বলেই অনেকে মনে করছেন । যাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উঠেছে তাদের একজন সাংবাদিক এবং অন্যজন ব্যবসায়ী। তবে তারা দুজনেই তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্র জগদের কিছু নারী তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে ‘মি-টু’ আন্দোলনের সূচনা করেন। হলিউডের পর বলিউডেও মি-টু আন্দোলনের আঁচ এসে লাগে। সেখানেও কিছু চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় ঘরে বাইরে, কর্মক্ষেত্রে এমনকি পরিবারের মধ্যেও বহু নারী যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় মেয়েরা লোকলজ্জার ভয়ে এগুলো গোপন করে রাখেন।
কিন্তু সেই গোপনীয়তার দেয়ালে চিড় ধরতে শুরু করেছে।বাংলাদেশি মেয়ে শুচিস্মিতা সীমন্তি হ্যাশট্যাগ মি-টু লিখে তার সঙ্গে ১১ বছর আগের ঘটনা ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন।উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপের থাকা সীমন্তি অভিযোগ করেছেন, ডিবিসি টেলিভিশনের সাংবাদিক প্রণব সাহার বিরুদ্ধে।
গত ৩০শে অক্টোবর সীমন্তি তার ফেসবুক পাতায় #মি-টু দিয়ে লিখেছেন তার যখন বয়স ১৬ তখন অভিযুক্ত ব্যক্তি তার শরীরে বহুবার আপত্তিকর-ভাবে স্পর্শ করেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি সবার অগোচরে এই বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছিলেন এবং ওই ঘটনা তার হৃদয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল।
এ ব্যাপারে সীমন্তি বিবিসিকে বলেন, “উনি ফ্যামিলি ফ্রেন্ড ছিলেন। উনি অনেক সময় আসতেন। আমি যখন পড়তাম আমার রুমে আসতেন এবং উনি যেভাবে টাচ করতেন এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে অনেকবার এ ঘটনা হয়েছে আমার সাথে। এতবার হয়েছে যে আমি হিসাবই করতে পারবো না। চেষ্টা করেছি যাতে একস্ট্রিম কোনও পর্যায়ে না যায়।”
সীমন্তির অভিযোগ নিয়ে জানতে প্রণব সাহার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে এক সপ্তাহ পরে ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে পোস্ট দিয়েছেন।
সীমন্তির মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং পারিবারিক ঘনিষ্ঠতার কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, “শুচিস্মিতা সিমন্তি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ১১ বছর আগে তার ১৬ বছর বয়সে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছে। যদিও ২০০৪ সালের দিকে কয়েক বছর প্রেমের সম্পর্কের সময় সুপ্রীতির ছেলে মেয়ে সীমন্তি ও সৌম্যকে নিজের সন্তানের মতই দেখেছি। তারাও নিশ্চিন্তে প্রণব মামার কোলেপিঠেই বড় হয়েছে।”
“পরিষ্কার করে বলতে চাই সন্তান-তুল্য সীমন্তি যে এক যুগ পরে এমন একটা অভিযোগ তুলতে পারে সেটাই আমার জন্য বড় পীড়াদায়ক।”
এ ঘটনা এতদিন চেপে রাখা প্রসঙ্গে সীমন্তি বলেন, “এই জিনিসটা আমি বাসায় বলতে পারিনি। কারণ, আমি তখন খুবই ছোট আর এরকম একটা বিষয়! উনি আমার বাবার বয়সী আমি কিভাবে বলি! ইভেন আমার ক্লোজ ফ্রেন্ডদেরকেও বলতে পারিনি। এটা একটা অস্বস্তির ব্যাপার ছিল।”
ফেসবুকে প্রথম পোস্ট করার পর গত ৪ঠা নভেম্বর প্রণব সাহার কর্মস্থলে অভিযোগের বিষয়টি উল্লেখ করে সীমন্তি একটি ইমেইল দিয়েছেন। সীমন্তি জানান, “মেইলে আমি সংক্ষেপে লিখেছি যে আমার সঙ্গে উনি ১১ বছর আগে এটা করেছেন। আর আমার ইচ্ছা ওনারা যেন একটু জিনিসটা ইনভেস্টিগেট করে দেখেন উনি এরকম আরও করেছেন কিনা বা করছেন কিনা?”
“আমি চাচ্ছি যে একটু অনুসন্ধান করা হোক যে উনি এরকম ঘটনা আরও করেছেন কিনা। উনি যে চ্যানেলে কাজ করেন সেখানে করেন কিনা? বা আগে করেছেন কিনা মিডিয়াতে।”
সীমন্তির এই অভিযোগ নিয়ে নানা আলোচনা এবং তার প্রতিষ্ঠানে ইমেইল পাঠানোর পর নারীনেত্রীদের একটি দল মি. সাহার কর্মস্থলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন এবং এর তদন্ত চান। প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের বিষয়ে একমত হয়েছে।
তবে প্রণব সাহা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “এ অভিযোগের যেমন কোনও ভিত্তি নাই তেমনি এটাকে ধরে আমাকে সামাজিক, মানসিক এবং পেশাগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করাও সমীচীন নয়। আমার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অপপ্রচারও গ্রহণযোগ্য নয়।”
অভিযোগ নিয়ে তদন্তের বিষয়টি নিজের লেখায় এনেছেন প্রণব সাহা, “আমি কৃতজ্ঞ আমার অফিস একতরফা আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে অভিযোগ তদন্তের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছেন। অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। শ্রদ্ধেয় সুলতানা কামাল, খুশি কবির এবং নাসিমুন আরা হক মিনু আপাই কমিটি গঠন করে দেবেন”
“শুধু আমার বিনীত অভিযোগ কমিটিতে এমন কেউ থাকবেন না, যে বা যারা এরই মধ্যে একটি পক্ষ নিয়েছে। আমার আবেদন সেই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে সামাজিকভাবে অপদস্থ করা, দোষী সাব্যস্ত করা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের জেরে আমার বর্তমান প্রতিষ্ঠানকে হেয় করা থেকে সবাই বিরত থাকবেন।”
সীমন্তি জানান, বিশ্বজুড়ে চলমান #মি-টু আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তিনি তার এই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। মি-টু আন্দোলনই তাকে সাহস যুগিয়েছে এই ঘটনা প্রকাশে।
“পরিচিত অনেকের কাছেই শুনেছি যে তাদের এমন অভিজ্ঞতা আছে কিন্তু এখনো বলতে পারেনি। আমি জাস্ট চেয়েছি যে অন্যরা যেন একটু সতর্ক হয়। কারণ এরকম ঘটনা প্রচুর।”
“একটা ফ্যামিলিও যদি তাদের বাচ্চাদের ব্যাপারে সচেতন হয় বা আমার সঙ্গে যারা ছোটবোন ফেসবুকে আছে তারা যদি এরকম ঘটনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, বাবা-মা’কে বলতে পারছে না, তারা যদি একটু সাহস করে বাবা-মা’কে বলতে পারে সেটাই আমার সার্থকতা।”
এদিকে, আয়ারল্যান্ড প্রবাসী মডেল এবং অভিনেত্রী মাকসুদা আক্তার প্রিয়তি গত ২৯শে অক্টোবর ফেসবুকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
মি. ইসলাম এই ঘটনা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন। একে তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলেও তিনি বিবিসির কাছে দাবি করেছেন।
ফেসবুকে প্রবাসী এই দু’জন বাংলাদেশী নারীর যৌন হেনস্তার অভিযোগ প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একে মি-টু আন্দোলনের সূচনা বলে অনেকে বর্ণনা করছেন।
এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা এবং বিতর্ক অব্যাহত আছে। এক্ষেত্রে প্রিয়তি এবং সীমন্তি প্রায় একই সুরে বলছেন, তাদের অভিযোগের পরিণতির ওপরে নির্ভর করতে পারে বাংলাদেশে মি টু আন্দোলনের ভবিষ্যৎ।
বাংলা৭১নিউজ/সূত্র:বিবিসি বাংলা/এসএস