বাংলা৭১নিউজ, ঢাকা: জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে আজ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ বাজেটের সম্ভাব্য আকার হচ্ছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। নির্বাচনী বছর হওয়ায় এবারের বাজেট সরকার ও সব শ্রেণীর মানুষের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
এবারের বাজেটটা সরকারের জন্য নানা বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ন। কারন চলতি বছরের শেষেই জাতীয় নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা।তদুপরি ভোটের আগে সরকারের দেওয়া নানা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্যও বাজেটটি হবে একটি চ্যালেঞ্জ নির্ভর বাজেট। আগামী ডিসেম্বরে ভোট হলে বর্তমান সরকার অবশ্য বাজেট বাস্তবায়নে পুরো সময় পাবে না।
জানা গেছে, নির্বাচন সামনে রেখে সরকার এবার বাজেটে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিচ্ছে না। তাই অন্যান্যবারের মতো নতুন নতুন কর চাপিয়ে ভোটারদের অসন্তুষ্ট করার মতো তেমন কোনো ঘোষণা এবার থাকছে না।
বিশ্বব্যাংক ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৭ থাকবে বলে অনুমান করছে। সেখানে অর্থমন্ত্রী আজ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ ধরে বাজেট উপস্থাপন করবেন। অর্থাৎ তিনি আর্থিক প্রবৃদ্ধির নিুমুখী প্রবণাতাকে মানতে রাজি নন। যদিও উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। এগুলো সমাধানে নানা দিকনির্দেশনা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় থাকবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, আগামী বাজেটে ব্যয়ের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। ফলে এ বাজেটে ঘাটতি থাকছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা, যা ডিজিপির ৪ দশমিক ৯ শতাংশের সমান। অন্যদিকে অনুদানসহ মোট আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এতে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আজ যে বাজেট পেশ করছেন, সেখানে মোট রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ব্যয় সংকোচন নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি সরকার। ২০১৮-১৯ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা, এনবিআর-বহির্ভূত কর খাতের আয় ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত রাজস্ব আয় ৩৩ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। এ বিপুল অঙ্কের রাজস্ব সংগ্রহের জন্য সরকারকে জিডিপির বৃদ্ধির হার বাড়াতে হবে। সরকারের অনুমান অনুযায়ী আগামী আর্থিক বছরে ডিজিপির আকার ধরা হয়েছে ২৫ লাখ ৩৭ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা। অবশ্য এটি চলতি জিডিপির তুলনায় ২ লাখ ৯৯ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা বেশি।
এবারের বাজেটে ঘাটতি পূরণ করতে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ঋণ গ্রহণ করবে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে কৃষকের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের তুলনায় কৃষিতে ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি ভর্তুকি দেয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এতে কৃষিতে মোট ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি থাকছে। এছাড়া এলএনজি আমদানি ও চাকরিজীবীদের গৃহনির্মাণ ঋণসহ বেশ কিছু খাত নতুন করে ভর্তুকির আওতায় আসছে। বিশেষ করে আগামী বছর থেকে ভর্তুকি দেয়া হবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)। অথচ চলতি অর্থবছর পর্যন্ত এ সংস্থাকে সরকার সহায়তা দিয়েছে ঋণ হিসেবে। পাশাপাশি সামনের বছরগুলোতে বাস্তবায়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে কয়লা, গ্যাস, তাপবিদ্যুৎ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ প্লান্টের। সে হিসাব করেই আসন্ন বাজেটে ৩১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে।
নির্বাচনের আগে সরকারি চাকরিজীবীসহ ভোটার টানার চেষ্টা করা হবে বাজেটে। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য পহেলা জুলাই থেকে কার্যকর হবে গৃহনির্মাণ ঋণ কর্মসূচি। এ ঋণ কর্মসূচি বাস্তবায়নসহ তাদের (চাকরিজীবী) বছরে ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট ধরে বেতন-ভাতা খাতে দেয়া হচ্ছে ৬৬ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। পাশাপাশি বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নতুন বাজেটে থাকছে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার রূপ রেখা।
জানা গেছে, ভোটে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে প্রায় ১১ লাখ দরিদ্র মানুষকে নতুন করে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে। এর ফলে এ কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর মোট সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৮৬ লাখ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মাতৃত্বকালীন ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা করা হচ্ছে। পাশাপাশি কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মায়ের (শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান এমন মা) ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৮০০ টাকা। এ দুটি ভাতা প্রাপ্যতার মেয়াদ ২ বছর থেকে বৃদ্ধি করে ৩ বছরে নেয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় ক্যান্সার, কিডনি, স্ট্রোক, প্যারালাইজড ও জন্মগত হৃদরোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচির জন্য ৫০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ কোটি টাকা দেয়ার প্রস্তাব করা হবে। এছাড়া দু’লাখ জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ সম্মাননা ভাতা চালুর ঘোষণা আসছে। ‘বিজয় দিবস ভাতা’ নামে এটি কার্যকর করা হবে। প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা বছরে ৫ হাজার টাকা হারে অতিরিক্ত এ ভাতে পাবেন।
ভোটার তুষ্ট করতে নতুন করে আরও এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তি (সরকারি বেতনের অংশ) করা হচ্ছে। এছাড়া জাতীয় বাজেটে প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে রোহিঙ্গারা। তাদের পুনর্বাসনের জন্য একটি প্রকল্প ইতিমধ্যে একনেকে অনুমোদন পেয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরসহ অবকাঠামো তৈরিতে বাজেটে ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
ছয়টি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে প্রণয়ন করা হচ্ছে আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়ন খাত। বিদ্যুৎ জ্বালানিসহ ভৌত অবকাঠামো এবং কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানও রয়েছে। পাশাপাশি সরকার সেবাদানে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নও থাকছে এ তালিকায়। অগ্রাধিকারে আরও থাকছে জলবায়ু মোকাবেলায় সক্ষমতা অর্জন এবং বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক সুযোগ ব্যবহার, রেমিটেন্স বৃদ্ধি ও পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টি। সরকারের শেষ বাজেট এসব বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েই প্রণয়ন করা হচ্ছে। বিশেষ অগ্রাধিকারের কারণে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে এসব খাতে।
তবে ব্যক্তিশ্রেণী আয়ের সীমা বাড়ানো হবে বলে এতদিন ঢাক-ঢোল পেটানো হয়েছে। কিন্তু জানা গেছে, এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেই বাজেটে। তবে সবাইকে সন্তুষ্ট করতে আসন্ন বাজেটে সাধারণ মানুষের ওপর নতুন কোনো করের বোঝা চাপছে না। নতুন করে করারোপ না করলেও কর্পোরেট করের কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। মাঝামাঝি স্তরে কর্পোরেট কর হার কিছুটা কমানো হবে। আর নিু ও উচ্চস্লাবের (২৫, ৪২ দশমিক ৫ ও ৪৫ শতাংশ) কর্পোরেট কর অপরিবর্তিত থাকছে। মোবাইল ও তামাকসহ কিছু ব্যতিক্রম কোম্পানি ছাড়া সর্বোচ্চ কর্পোরেট কর ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। তবে মোবাইল ও তামাক কোম্পানির জন্য দু’টি রেট রাখা হয়েছে, তা হচ্ছে ৪২.৫ ও ৪৫ শতাংশ। ৩৭.৫ শতাংশের নিচেরগুলোতে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।
এছাড়া ভ্যাট কাঠামোতে আসছে বড় পরিবর্তন। ৯ স্তর থেকে কমিয়ে ৫ স্তরের ভ্যাট করা হচ্ছে। এসব স্তর হবে যথাক্রমে- ২, ৫, ৮, ১২ ও ১৫। এছাড়া কালো টাকা সাদা করার কোনো বিশেষ সুযোগ থাকছে না।
বাজেটে রাজস্ব আয়ের প্রধান খাত তামাকের ওপর কর বাড়ানো হচ্ছে।নিন্মস্তরের সিগারেটের মূল্য ২৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করা হচ্ছে। এ সিগারেটের প্যাকেটে সম্পূরক শুল্ক ৬৫ শতাংশ আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া উচ্চস্তরের সিগারেটের দাম ৭০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফিলটার যুক্ত দশ শলাকার বিড়ির প্যাকেটের দাম ৬ টাকা থেকে ৭ টাকা এবং ২০ শলাকারের দাম ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৫ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া দশ গ্রাম ওজনের জর্দা ও গুলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ টাকা।
এছাড়া আমদানিতে অগ্রিম ভ্যাট বা এটিভি বাড়ানো হচ্ছে। ফলে আমদানিনির্ভর পণ্য মূল্য বাড়বে। ভ্যাট ও শুল্ক খাতে বেশকিছু পরিবর্তনের ঘোষণা থাকবে।
স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা ও প্রসারের স্বার্থে শুল্ক ও অন্যান্য বিষয়ে বেশকিছু উদ্যোগ থাকবে। একই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়, এমন পণ্যের আমদানিকেও নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ থাকছে। কিছু বিলাসজাত দ্রব্য আমদানি নিরুৎসাহিত করার ঘোষণাও থাকছে। এর ফলে স্থানীয় শিল্প প্রসারের সুযোগ থাকবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী।
সূত্রমতে, মোটরসাইকেল, কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন উৎপাদনে ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) অব্যাহতি দেয়ার পাশাপাশি কিছু শিল্পের যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্কের ক্ষেত্রেও ছাড় দেয়া হতে পারে। ফলে দেশে এ ধরনের শিল্পের সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরি হতে পারে। হাইব্রিড গাড়িতে সুবিধা অপরিবর্তিত থাকলেও রিকন্ডিশন্ড গাড়ির অবচয় সুবিধা কমছে।
এছাড়া এবারের বাজেটে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে ই-কমার্স সেবায়। বিলাস দ্রব্য হিসেবে হেলিকপ্টার সেবায় ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক (এসডি) আরোপ হতে পারে। ভ্যাট আদায় বাড়াতে হিসাবের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ইসিআরের বদলে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার ঘোষণাও থাকছে।
এদিকে জনগণের করের টাকা দিয়ে সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কড়া সমালোচনা হচ্ছে। এরপরও মূলধন ঘাটতি মেটাতে এ খাতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এছাড়া পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২ হাজার কোটি টাকা।
বাংলা৭১নিউজ/এসএসএইচ