অ্যালেক্স ইসকল্ড নামের একজন মার্কিন উদ্যোক্তা একবার অদ্ভুত এক ভবিষ্যদ্বাণী করে বসলেন। তিনি নাকি তথ্য খোঁজার নতুন মাধ্যম দেখতে পাচ্ছেন সামনে! তবে সেটা গুগল নয়। অথচ বর্তমান প্রজন্মের তথ্যপ্রযুক্তিভাবনা সেই গুগলে শুরু হয়ে গুগলেই শেষ হচ্ছে। এখানে মনে রাখা দরকার, একসময়ের শীর্ষে থাকা মোবাইল ফোন কোম্পানি মটোরোলার যুগ শেষ হয়ে নকিয়ার যুগ শুরু হয়েছিল। সেই নকিয়াও অবশ্য শেষ পর্যন্ত পথে বসেছিল!
একটা প্রশ্ন, গত এক মাসে সবচেয়ে বেশি শোনা তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের নাম কী? নিঃসন্দেহে ফেসবুক। দুই দিনের ডেভেলপার সম্মেলন এবং সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসেবে চমৎকার যেসব (কিছু অবশ্য আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত) নতুন পণ্য ও সুবিধার ঘোষণা দিয়েছে ফেসবুক, তাতে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মনে একটা প্রশ্ন নতুন করে দেখা দিচ্ছে—গুগলের অবস্থান কোথায়?
লাইভ ভিডিওতে বাজিমাত
ফেসবুকের সবচেয়ে বড় শক্তি এর বিপুল ব্যবহারকারী। এই শক্তির জোরেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুগলকে একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে তারা। অথচ শীর্ষে থাকার কথা কিন্তু গুগলেরই। তাদের জনবল বেশি, পণ্যের বহর বেশি, বাজারমূল্য বেশি, অধিগ্রহণ করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেশি। তারপরও ফেসবুকের এই ‘ঔদ্ধত্য’ ব্যবসায়ের পট রীতিমতো পাল্টে দিয়েছে। লাইভ ভিডিওর কথাই ধরা যাক। ভিডিও চালানোর সেবা হিসেবে ইউটিউব এখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে, তাদের লাইভ ভিডিও সেবাও আছে। গুরুত্বপূর্ণ সব অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তবে সাধারণের হাতে সম্প্রচারের সুবিধাটি তুলে দিয়েছে ফেসবুক। আরেকটা ব্যাপার হলো, ইউটিউবে ভিডিও খুঁজে নিতে হয়, ফেসবুকে পেয়ে যাবেন নিজের নিউজফিডেই।
এখন প্রশ্ন হলো, ফেসবুক কেন লাইভ ভিডিও চালু করেছে? উত্তরটা হলো, বিজ্ঞাপনী আয়ের সম্ভাবনা অসীম। ইউটিউবের এই আয় প্রচুর। কারণ, তাদের উচ্চমানের অনেক কনটেন্ট আছে, প্রতিনিয়ত নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। প্রকাশকেরা ইউটিউবে নিজেদের কনটেন্ট শেয়ার করতে ভরসা পান, চুরি হওয়ার ভয় কম। এখন যদি সেই ভরসার জায়গাটা ফেসবুক তৈরি করতে পারে? ভিডিওর জন্য মানুষ কেন ফেসবুক ব্যবহার করবে না! ডেভেলপার সম্মেলনেই জাকারবার্গ বাহিনী কিন্তু সেই ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন।
চ্যাটবটের উত্থান
ব্যবহারকারীর সম্পৃক্ততা বাড়াতে বার্তা আদান-প্রদান বা মেসেজিং অ্যাপের বিকল্প নেই। এক হাতে হোয়াটসঅ্যাপ এবং অন্য হাতে মেসেঞ্জার নিয়ে ফেসবুক এদিকটায় গুগলের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে আছে। গুগলের অবশ্য হ্যাংআউট আছে। এতে ব্যক্তিগত তো বটেই, গ্রুপ ভিডিও কলের সুবিধা আছে, যা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গ্রাহকদের সেতুবন্ধ তৈরি করে। তবে নতুন মেসেঞ্জার প্ল্যাটফর্মের ঘোষণা দিয়েছে ফেসবুক। যেখানে স্বয়ংক্রিয় চ্যাটবট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে গ্রাহকদের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যেতে পারবে অনেকটা মানুষের মতো করেই। ব্যবহারকারীর দৈনন্দিন কাজের বেশির ভাগ যেন মেসেঞ্জারে সারা যায়, সেটাই এখন ফেসবুকের লক্ষ্য।
গুগলের ডেরায় হানা
মনে করুন, কোনো এক দুষ্টু ছেলের দুষ্টুমির দাপটে কফির কাপটা উল্টে পড়ল আপনার পাট ভাঙা সাদা শার্টে। কী করবেন? দুটি কাজ করতে পারেন। গুগলে খুঁজে দেখতে পারেন কীভাবে এই দাগ তোলা যায়। গুগল আপনাকে শুরুতে তিন লাইনের বিজ্ঞাপনসহ ১০ ফলাফলের এক পাতা দেখাবে, যেখানে আপনাকে দরকারি তথ্যটি খুঁজে নিতে হবে। আবার আপনি কোনো এক ডিটারজেন্ট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মেসেঞ্জার বটকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে পারেন। বট আপনাকে ভিডিওতে দেখিয়ে দেবে যে কীভাবে তা পরিষ্কার করতে হয়। কোনটি সহজ? লেখার শুরুতে অ্যালেক্স ইসকল্ডের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা লিখেছিলাম। পরে তিনি আরও যোগ করেছিলেন, গুগলের কাজটা দখল করে নেবে টেক্সট মেসেজিং। মেসেঞ্জার ঠিক সেই কাজটাই কিন্তু করছে। ‘গুগল নাউ’ অবশ্য অনেকটা কাছাকাছি ধরনের কাজ করে, তবে ব্যবহারকারীর সংখ্যার হিসাবে তা খুবই নগণ্য।
তবে কি গুগলের দিন ফুরিয়ে গেল? তা বলার সময় অবশ্য এখনো আসেনি। কোনো না কোনো দিক থেকে তারা এগিয়ে আছে। তা ছাড়া আগামী মাসে গুগলের নিজস্ব ডেভেলপার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। নিশ্চয় চমকপ্রদ কিছু ঘোষণা আসবে লাইভ ভিডিও কিংবা স্মার্ট চ্যাট নিয়ে। তবে যত যা-ই করুক, শুরুটা কিন্তু ফেসবুকই করল।
গুগলের অ্যাডভান্সড টেকনোলজি অ্যান্ড প্রোজেক্টসের (এটিএপি) বিভাগীয় প্রধানের পদ ছেড়ে দিন চারেক আগে রেজিনা ডুগান ফেসবুকে যোগ দিয়েছেন হার্ডওয়্যার গবেষণা ও উন্নয়ন দলের নেতৃত্ব দিতে। শেরিল স্যান্ডবার্গও কিন্তু গুগল ছেড়েই ফেসবুকে এসে প্রতিষ্ঠানটির পট আপাদমস্তক পাল্টে দিয়েছেন, দিচ্ছেন। তা ছাড়া এক দশকের যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি, তাতে সামনের দিনগুলো যে ফেসবুকের নয়, তা নিশ্চিত করে বলার সুযোগ কই?
সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার, ম্যাশেবল