জাল সনদ ব্যবহার করে নওগাঁর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ২০ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে এমপিওভুক্ত হওয়ায় ১০ জন শিক্ষক সরকারি কোষাগার থেকে অবৈধভাবে বেতন উত্তোলন করেছেন ৬৫ লাখ ৯৭ হাজার ৩৭৬ টাকা। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) সনদ যাচাই বাছাইয়ে এ ভয়াবহ জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে। এরপরই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও অবৈধভাবে গ্রহণকৃত বেতনের টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত আনাসহ বহুবিধ নিদের্শনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
তবে অদৃশ্য কারণে গত দেড় বছরে অভিযুক্ত এসব শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখেনি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ। জাল সনদে চাকরিরতদের কয়েকজন এখনো রয়েছেন বহাল তবিয়তে। ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন অবৈধ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দাতারাও। এতে সরকারি কোষাগার থেকে অবৈধভাবে উত্তোলন করা বেতনের লাখ লাখ টাকা ফেরত আনা নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা।
জানা যায়, গত বছরের ১৮ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অভ্যন্তরীণ ও নিরীক্ষা শাখা থেকে সহকারী সচিব মো. সেলিম শিকদার স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে সারাদেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৬৭৮ জন জাল সনদধারী শিক্ষক/কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থ্যা গ্রহণের নিদের্শনা দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) যাচাই বাছাইয়ে জাল সনদধারীদের এ চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হয়েছে বলেও জানানো হয় ওই প্রজ্ঞাপনে।
সেইসঙ্গে জাল সনদধারীদের পরিচয় প্রকাশ করে এসব শিক্ষকদের এমপিও ও চাকুরিচ্যুত করাসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ওই তালিকার তথ্যমতে, নওগাঁ সদর উপজেলার শেরে বাংলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (কম্পিউটার) উম্মে রুহানী নেকটার বগুড়ার জাল সনদে চাকরি করে ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৮৮৭ টাকা, চক আতিথা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (কম্পিউটার) সাঈদ মো. রশিদুল যোবায়েদ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর নওগাঁর জাল সনদে চাকরি করে ১০ লাখ ৩৩ হাজার ২১৮ টাকা, শিকারপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (কৃষি) মো. রেফাজ আহম্মেদ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের জাল সনদে চাকরি করে ৫ লাখ ৪০ হাজার ৯৮০ টাকা এবং কুশাডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (শরীর চর্চা) অবিনাশ চন্দ্র প্রামাণিক বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের জাল সনদে চাকরি করে ১ লাখ ৫১ হাজার ৫৫৫ টাকা অবৈধভাবে বেতন হিসেবে সরকারি কোষাগার থেকে উত্তোলন করেছেন।
এছাড়া পোরশা উপজেলার গাঙ্গুরিয়া ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক (কম্পিউটার) মো. মাহমুদ হাসান মন্ডল জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমী বগুড়ার জাল সনদে চাকরি করে ৯ লাখ ৩৪ হাজার ৯৬১ টাকা এবং নিসকিনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (কম্পিউটার) মো. তোজাম্মেল হক জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমী (নেকটার) বগুড়ার জাল সনদে চাকরি করে ৮ লাখ ৫৪ হাজার ৬৫ টাকা বেতন হিসেবে সরকারি কোষাগার থেকে উত্তোলন করেছেন।
মান্দা উপজেলার মান্দা থানা আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের সহকারী শিক্ষক (শরীর চর্চা) পাপিয়া খান বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের জাল সনদে চাকরি করে ৫ লাখ ২ হাজার ৪৬০ টাকা অবৈধভাবে বেতন হিসেবে সরকারি কোষাগার থেকে উত্তোলন করেছেন।
পত্মীতলা উপজেলার চক মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (ধর্ম) ইয়ারুন নাহার বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের জাল সনদে চাকরি করে ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৮৬০ টাকা বেতন হিসেবে সরকারি কোষাগার থেকে উত্তোলন করেছেন।
আত্রাই উপজেলার চক শিমলা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (ইংরেজী) মো. মোজাহারুল ইসলাম বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের জাল সনদে চাকরি করে ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৪৪০ টাকা এবং সুদরানা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (ইসলাম ধর্ম) মো. শরিফুল ইসলাম বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের জাল সনদে চাকরি করে ২ লাখ ৫০ হাজার ৯৫০ টাকা অবৈধভাবে বেতন হিসেবে সরকারি কোষাগার থেকে উত্তোলন করেছেন।
অপরদিকে বদলগাছী উপজেলার গোবর চাপাহাট ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক (দর্শন) মোসা. ফাহমিদা সরকার, প্রভাষক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) শিউলি বিশ্বাস, প্রভাষক (অর্থনীতি) মো. রিয়াজুল ইসলাম এবং প্রভাষক (আরবী) মো. আনোয়ার হোসেন বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের জাল সনদে চাকরি করলেও প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় তারা সরকারি কোষাগার থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারেননি।
একই উপজেলার মিঠাপুকুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (শরীর চর্চা) মোছা. রোকাইয়া সুলতানা বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের জাল সনদ ব্যবহার করে চাকরি করলেও তিনিও এমপিওভুক্ত না হওয়ায় সরকারিভাবে বেতন পাননি।
মান্দা উপজেলার উত্তরা ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক (বাংলা) পপি রানী এবং চকউলী ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক (সমাজ বিজ্ঞান) মো. মহসীন হাবিব বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের জাল সনদ ব্যবহার করে চাকরি করলেও প্রতিষ্ঠান ২টি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় তারা সরকারি কোষাগার থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারেননি।
রাণীনগর উপজেলার গোনা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (গণিত ও বিজ্ঞান) মো. তরিকুল ইসলাম, সহকারী শিক্ষক (গণিত) মো. সাহাব উদ্দিন এবং সহকারী শিক্ষক (সমাজবিজ্ঞান) মো. মিজানুর রহমান বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের জাল সনদ ব্যবহার করে চাকরি করলেও প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় তারা সরকারি কোষাগার থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারেননি।
এ তালিকা অনুযায়ী মান্দা উপজেলার মান্দা থানা আদর্শ বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ১৫ বছর আগে জাল সনদে সেখানে সহকারী শিক্ষক (শরীর চর্চা) হিসেবে যোগদান করেছিলেন পাপিয়া খান। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) নিদের্শনার অনেক আগেই স্থানীয় থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন তৎকালীন প্রতিষ্ঠান প্রধান। মামলাটি বর্তমানে নওগাঁর আদালতে চলমান রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অধ্যক্ষ খালেনুর বেগম বলেন, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের আগে চলতি বছরের জুলাই মাসে এখানে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেছি। যোগদানের পর যতটুকু জেনেছি পাপিয়া খানের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর অসংখ্যবার অবৈধভাবে গ্রহণকৃত বেতন ভাতার ৫ লাখ ২ হাজার ৪৬০ টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে তাগাদা দেওয়া হয়েছে।
এরপরেও তিনি এখন অবধি সেই টাকা ফেরত দেননি। মাউশির নতুন নিদের্শনার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। ওই টাকা দ্রুত সরকারি কোষাগারে ফেরত আনাসহ এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িতদের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সরকারি কোষাগারে টাকা ফেরত না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে পাপিয়া খান বলেন, আমার সনদটি জাল ছিল না। ১৫ বছর আগে নিয়োগের সময় সনদ যাচাই বাছাই করেই প্রতিষ্ঠান আমাকে সেখানে নিয়োগ দিয়েছিল। তাই নিজ অবস্থান থেকে মামলাটি চালিয়ে যাচ্ছি। যেহেতু আমি নির্দোষ তাই সরকারি কোষাগারে টাকা ফেরত দিইনি।
পোরশা উপজেলার গাঙ্গুরিয়া ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক মো. মাহমুদ হাসান মন্ডল জাল সনদে চাকরি করে ৯ লাখ ৩৪ হাজার ৯৬১ টাকা সরকারি কোষাগার থেকে উত্তোলন করেছেন। এরপরও ওই প্রতিষ্ঠান এখনো তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বহাল তবিয়তে থেকে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছেন এই শিক্ষক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত মাহমুদ হাসান মন্ডল বলেন, উচ্চ আদালতে এ বিষয়ে আপিল করেছি। এখনো পূর্ণাঙ্গ রায় আসেনি। তবে আমার ওই সার্টিফিকেটটি আসল না হলেও অন্য সবকটি ঠিক আছে। তাই মনে করি এখানে অবৈধভাবে কিছু করা হয়নি। উচ্চ আদালতের রায়ে যদি হেরে যাই তখন বেতন ফেরত দেওয়া বা না দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো।
নওগাঁ সদর উপজেলার শেরে বাংলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক উম্মে রুহানী নেকটার বগুড়ার জাল সনদে চাকরি করে ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৮৮৭ টাকা সরকারি কোষাগার থেকে অবৈধভাবে উত্তোলনের পরও কীভাবে বহাল তবিয়তে আছেন জানতে প্রধান শিক্ষকের ব্যবহৃত মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি নানান টালবাহানা শুরু করেন। নাম জানতে চাইলে নিজের নাম প্রতিবেদককে জানাতেও অস্বীকৃতি জানান। এক পর্যায়ে মাউশি থেকে কোনো নির্দেশনা পাননি বলে দাবি করেন।
তিনি বলেন, প্রায় ২১ বছর যাবত উম্মে রুহানী এখানে চাকরি করছেন। তার নিয়োগের সময় আমি সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ওই নিয়োগ তৎকালীন সভাপতি দিয়েছেন। তাই সনদ জাল হলেও আমাদের দেখার সুযোগ ছিল না।
অপরদিকে গত ৩ অক্টোবর জাল সনদে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরিরতদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গভর্নিং বডিকে নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। বিষয়টি নিয়ে ওইদিন মাউশির সহকারী পরিচালক (কলেজ-৩) তপন কুমার দাস স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। তবে রহস্যজনক কারণে গভর্নিং বডির পাশাপাশি বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন শিক্ষা কর্মকর্তারাও।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মাহফুজা খাতুন বিষয়টি অবগত নন বলে দাবি করেন। এমনকি এ সংক্রান্ত কোনো বিজ্ঞপ্তি জারির তথ্যও তার জানা নেই বলে জানান তিনি। কেউ সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন এই কর্মকর্তা।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ