ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে গা-ঢাকা দেওয়া গান বাংলা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কৌশিক হোসেন তাপস গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবলাবাদক থেকে টিভি চ্যানেলের কর্ণধার হওয়া তাপস বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নানা কারণে আলোচিত ছিলেন। তার উত্থান নিয়েও নানা মুখরোচক গল্পের ছড়াছড়ি মিডিয়া পাড়ায়।
কৌশিক হোসেন তাপস ছিলেন একটি বেসরকারি টেলিভশন চ্যানেলের তবলা বাদক। বিগত প্রধানমন্ত্রীর সাবেক ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নজরে আসেন তাপস। তার স্ত্রী ফারজানা মুন্নি ছিলেন শেখ হাসিনার বিউটিশিয়ান।
এরপর তাপস-মুন্নি দম্পতিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাপস দিনে দিনে হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বড় বড় অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ছিল তার। এভাবে কামিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। মালিক বনে যান গান বাংলার।
অভিযোগ রয়েছে, গান বাংলা চ্যানেলের আড়ালে নারী সাপ্লাইসহ নানা অপকর্মে জড়িত ছিলেন। এমনকি স্ত্রী ফারজানা মুন্নী এই অপকর্মে স্বামী তাপসের সহযোগী ছিলেন। এই দম্পতির সঙ্গে বিশেষ খাতির ছিল সালমান এফ রহমানের।
তাপস দম্পতি দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন পর্ণ অভিনেত্রী সানি লিওনকে তাদের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে এনে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নিষেধ উপেক্ষা করে সানি লিওনকে ঢাকায় এনে তাপস নিজের শক্তি দেখান। এতে পরোক্ষ সহযোগিতা করেন সালমান এফ রহমান। মেয়ের বিয়ের অতিথি হিসেবে আনা হলেও রাঘব-বোয়ালদের মনোরঞ্জন করতেই তাকে আনা হয়।
এছাড়া ভারতীয় অনেক নায়িকাকে অনুষ্ঠানের নামে নিয়মিত ঢাকায় আনতেন। এদের মধ্যে নুসরাত জাহান, মিমি চক্রবর্তী, নার্গিস ফাখরিসহ অনেকেই আছেন। তারাও তাপসের মাধ্যমে মনোরঞ্জন সার্ভিস দিতে আসতেন বলে কানাঘুষা আছে।
এছাড়া কর ফাঁকি দিয়ে গানবাংলার নাম করে ইউক্রেন থেকে নারী এনে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি, আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করার অভিযোগও রয়েছে তাপসের বিরুদ্ধে। এমন দুটি ঘটনায় শাহজালালে দেশটির কয়েকজন নারীকে আটকে দিয়েছিল ইমিগ্রেশন পুলিশ। তখন প্রভাব খাটিয়ে তাদের ইমিগ্রেশন করিয়ে নেন তাপস।
নারীকেন্দ্রিক কুকীর্তিই শুধু নয়, তাপসের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিগত সরকারের অনেক মন্ত্রী-আমলার প্রভাব খাটিয়ে সংগীতাঙ্গনকে কুক্ষিগত করে রাখেন। গানবাংলাকে ঘিরে তিনি রীতিমতো যেনতেন কর্মকাণ্ড শুরু করে আসছিলেন।
তাপসের স্ত্রী ফারজানা মুন্নি শেখ হাসিনার বিউটিশিয়ান হবার সুবাদে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতার সঙ্গে তার ওঠাবসা ছিল তাদের। সেটাকেই কাজে লাগান তাপস। স্ত্রীর কারণে হয়ে ওঠেন ক্ষমতাবান। প্রভাব বিস্তার করেন সংস্কৃতি অঙ্গনে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সব থেকে বড় প্রজেক্ট ছিল জয় বাংলা কনসার্ট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ উপলক্ষে এই কনসার্ট আয়োজন করা হতো। পুরো অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন তাপস। এ থেকে কোটি কোটি টাকা ঘরে তোলেন তিনি। শিল্পীদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের বড় অংশ তিনি নিজের পকেটে ভরতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তৎকালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদের আস্থাভাজন ছিলেন তাপস। ফলে সরকারি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কাজ সহজেই পেয়ে যেতেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে কনসার্ট আয়োজনের কাজও বাগিয়ে নিতেন তিনি।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন আয়োজিত লাল-সবুজের মহোৎসব, মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান থেকেও হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। ২০২২ সালে বরিশালে ‘জয়বাংলা উৎসব’ নামে অনুষ্ঠানে ভারত থেকে মিমি চক্রবর্তীসহ অনেক তারকাকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। সেখানে সালমান এফ রহমান ছিলেন প্রধান অতিথি। এছাড়া বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহও ছিলেন।
আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া তাপসের কাছে এক প্রকার জিম্মি ছিল দেশের অনেক মেধাবী শিল্পী। কাজ পেতে তাদের কেউ কেউ তাপসের পেছন পেছন ঘুরতেন। তাপসের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরলে তাদের কেউ কেউ বড় আয়োজনে গান গাওয়ার সুযোগও পেতেন।
গ্রেপ্তার কৌশিক হোসেন তাপসকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। রাজধানীর উত্তরায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলার ঘটনায় করা এক মামলায় এজাহারনামীয় আসামি তিনি। রাজধানীর প্রগতি সরণিতে গান বাংলা টেলিভিশনের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এর আগে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিন গান বাংলার কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। তবে জনরোষ এড়াতে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সরকার ঘনিষ্ঠ তকমা পাওয়া কৌশিক হোসেন তাপস।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ