বাংলা৭১নিউজ ডেস্ক: বারোটা বাজার এখনো কয়েক মিনিট বাকি। আতশবাজির শব্দে কানপাতা দায়। এমনিতে এসব ব্যাপারে অণুর উৎসাহ কম। কিন্তু আজ ছাদে গিয়ে মানুষের আনন্দ দেখার খুব ইচ্ছে হলো। কণাকে অনেক ঠেলেও লাভ হলো না। সে এখন চ্যাটিং-গ্রিটিংস নিয়ে ব্যস্ত। তাই সে একাই চলে এলো। ছাদে সে কখনও ওঠে না। আসলে ইচ্ছে হয় না। এত বছরে এটা বুঝি তৃতীয়বারের মতো তার ছাদে আসা। তাদের ছাদটা আজ উৎসবহীন, চুপচাপ, অন্ধকার… এই বিল্ডিংয়ে আনন্দ করার মতো কেউ নাই নাকি! ছাদের আলো নিয়ে বাড়িওয়ালা কৃপণতা করলেও ঠিক মাথার উপরে চাঁদটা নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছে।
বাপরে! কি সেলিব্রেশনটাই না হচ্ছে চারপাশে! নগরীর চোখে আজ ঘুম নেই। যান্ত্রিক ঢাকার অন্ধকার ফুড়ে ছাদে ছাদে চলছে আলো আর শব্দের উৎসব। বাচ্চারা মশারি থেকে বেরিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বাবার হাত ধরে ছাদে চলে এসেছে। কত্ত ফানুস ওড়াচ্ছে মানুষ… কিছু তো খুব কাছ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে… ধরে ফেলা যাবে। আকাশ ভরা দিশেহারা, জ্বলন্ত ফানুস আর আতশ-আলোর ঝলকানি। দারুণ তো!
অণুর মনে হলো উৎসবের আমেজটুকু বাদ দিলে এখনকার সিটি ইমেজটা যেন কিছুটা একাত্তরের যুদ্ধের সময়ের সাথে মিলে যাচ্ছে- সতর্ক সাইরেন বাজিয়ে দ্রুতযানে পেট্রোল করছে র্যাব-পুলিশের স্পেশাল টিম, তার মধ্যে আতশ নয় যেন অবিরাম গোলাগুলির শব্দ, বাতাসে বারুদ পোড়ার মতো গন্ধ, বিভ্রান্ত কিশোর-যুবকরা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাস্তায় একত্রিত হবার সুযোগ সন্ধানে ব্যস্ত… একপাশের রেলিং-এ দাঁড়িয়ে এসব দেখে খুব মজা পাচ্ছিল অণু।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা শক্ত হাত তার কাঁধে ঝাকি দিয়ে তাকে একপাশে সরিয়ে দিলো। অণু চমকে পিছনে তাকালো। লম্বা একটা ছেলে। আগুন বাঁচিয়ে একটা মাঝারি ফানুস সামলাতে ব্যস্ত। অণুর ভীত-বিস্মিত মুখ দেখে হেসে বলল, ভয় পাবেন না। ফানুসটা একদম আপনার ঘাড়ের উপর এসে পড়ছিল। আরেকটু হলে চুলে আগুন লেগে যেত।
অণু চুপচাপ ধরনের মেয়ে। কী বলবে ভেবে পেলো না। বলল, থ্যাংকস।
ছেলেটা ছোট্ট করে বলল, জি। তারপরই যেন তার কথার অর্গল খুলে গেল। কৌতূহলী কণ্ঠে বলল,
আপনারা পাঁচ তলায় থাকেন, তাই না? আপনাকে আমি বেশ কয়েকবার সিঁড়ি ক্রস করার সময় দেখেছি। আপনার বোধ হয় সবুজ রং পছন্দ। বেশিরভাগ দেখি সবুজ রঙের ড্রেস পরেন। আপনি তো মাথা নিচু করে চলেন। তাই হয়তো আমাকে খেয়াল করেননি।
অণু কী বলবে ভেবে পেল না। শুধু বলল, হতে পারে।
আমি কে জানতে চাইলেন না? ছেলেটি প্রশ্ন করল। কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল, আমরা এই চিলেকোঠার নতুন ভাড়াটে। মাসখানেক হলো এসেছি। এই ছাদটা তো আমার কাছে ঘরের উঠোন। বেশিরভাগ সময় এখানেই কাটাই। শীতটা দারুণ উপভোগ করছি! ভোরের কুয়াশায় এক কাপ কফি খেতে আসি। বেলা হলে মিষ্টি রোদ গায়ে লাগিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে কিছু সময় কাটাই। আর সন্ধ্যা বা রাতে হাঁটাহাঁটি তো রেগুলার। ওই সময়টা আমার একা থাকার সময়। আজ হয়তো লোকজন ছাদে আসতে পারে তাই দেরি করে এসেছি। তবে ঠিক সময়ই এসেছি কিন্তু। ছাদে পা দিয়েই দেখি ফানুসটা ঠিক আপনাকে টার্গেট করেই ল্যান্ড করছে।
অণু পুনরায় ছোট্ট করে বলল, ও আচ্ছা।
ছেলেটা তো প্রচুর কথা বলে! কথা বলতে বলতে হাসে আবার হাসতে হাসতে কথা বলে। সে এতদিন জানতো, মেয়েরাই শুধু এত বকবক করে! এই ছেলের কি কন্যা রাশি?
আপনার সুন্দর চুলগুলো পুড়ে যাওয়া থেকে বাঁচালাম। ছেলেটা পুনরায় কথা বলে, নামটা তো জানতে পারি?
অণু।
ও হো… একটা সময় ভীষণ যন্ত্রণা দিয়েছেন। দিন-রাত আপনাকে নিয়েই ভাবতে হতো।
মানে?
আমি কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়েছি। অণু-পরমানু নিয়েই ছিল কারবার। তাই বললাম আর কি হা হা হা।
অণু এবার সরাসরি তাকাল। লালচে আলোয় ছেলেটার হাসি কি সুন্দরই না লাগছে! ফানুসটা দুজনের মাঝখানে জ্বলতে জ্বলতে ফুরোবার অপেক্ষায়। খুব কাছ দিয়ে আরেকটা ফানুস উড়ে গেলো। ছেলেটা লাফিয়ে ধরার চেষ্টা করলো। পরমুহূর্তেই ভ্রু বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, বছরটা কি কিপটেমি করেই শেষ করবেন?
অণু এই হেয়ালির অর্থ খুঁজে পেল না। সে কৌতূহলী চোখে তাকাল। ছেলেটি এবার হেসে বলল, কথা বলছেন না তো, তাই।
তারপরই আবার সেই হাসি। ছেলেটা এতো হাসে কেন?
হঠাৎ চারপাশ কাঁপিয়ে আবারো ফুলঝুরি ফুটতে লাগলো। আলোর ঝলকানিতে ছাদটা ক্ষণিকের জন্য বেশি আলোকিত হয়ে উঠলো কি? পাশের বাড়ি থেকে Tim McMorris এর গান ভেসে এল- ItÕs a new chance, for a new life … everything youÕve been waiting for… ItÕs a brand new year…
অণুর মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। রাত বাড়ছে যাই বলেই সে দ্রুত পা বাড়াল। পেছন থেকে ভেসে এলো ছেলেটির হাসি আরে! হ্যাপি নিউ ইয়ার অন্তত বলে যান।
এই ক’টা সিঁড়ি ভাঙতে অণুর এতো কষ্ট হচ্ছে কেন আজ? হুড়মুড় করে এতো প্রশ্নই বা কোথা থেকে ছুটে আসছে? ছেলেটার নাম জানা হলো না। সত্যিই কি তার সবুজ ড্রেসের সংখ্যা বেশি? সে-ও তো ভোরে কফি খায়। এক ভোরে ছাদে কুয়াশার মধ্যে কফি খেয়ে দেখলে কেমন হয়? বারান্দার গাছগুলোকে মাঝে মাঝে ছাদে রোদে দেয়া উচিৎ নয়? কিংবা গরমের সময় আচার? আচ্ছা, ছাদের ডুপ্লিকেট চাবি বানানো আছে কি?
লেখক:মুফতানিয়া তানি
বাংলা৭১নিউজ/সিএইস