বিএনপি আজ ঢাকায় মহাসমাবেশ করছে। পাল্টা সমাবেশও করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। শেষ মুহূর্তে পুলিশ সমাবেশের অনুমতি দিলেও ঢাকায় দেড় কিলোমিটার দূরত্বে মহাসমাবেশ ও পাল্টা সমাবেশকে কেন্দ্র করে একধরনের উত্তেজনা রয়েছে।
বিএনপির সমাবেশে যোগ দিতে আসা কর্মীদের আটকাতে রাজধানীর সব কটি প্রবেশমুখে তল্লাশিচৌকি, বাধা, গ্রেপ্তার অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। অন্যদিকে এ সমাবেশকে ঘিরে গত কয়েক দিনে ক্ষমতাসীনদের হুঁশিয়ারিতে পরিবেশ আও উত্তপ্ত হয়েছে।
ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশের অনুমতি পাওয়ার প্রশ্নেই সৃষ্টি হয়েছিল টান টান উত্তেজনা। নয়াপল্টনে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না—তিন দিন ধরে এমন বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী এবং পুলিশের কর্মকর্তারা।
অবশ্য গত বুধবার বিকেলে পুলিশের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। অবশেষে গতকাল শুক্রবার রাত নয়টার দিকে পুলিশ নয়াপল্টনে বিএনপিকে এবং জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামীকে ঢাকায় সমাবেশের অনুমতি দেয়নি পুলিশ।
কাকরাইলের একটি ভবন থেকে গতকাল রাতে বিএনপির নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ বলছে, বিএনপির ওই নেতা–কর্মীরা মহাসমাবেশ ঘিরে নাশকতার উদ্দেশ্যে সেখানে অবস্থান করছিলেন।
এদিকে, শেষ মুহূর্তে সমাবেশের জায়গা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটলেও, সারা দেশে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকাসহ দেশের ১৮টি জেলায় ৪২৬ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর কাকরাইলের একটি ভবন থেকে বিএনপির প্রায় দুই শ নেতা–কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ।
দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢাকায় আসতে মহাসমাবেশের আগের দিনেও পথে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের। রাজধানীর সব কটি প্রবেশমুখে পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা নগরীর ভেতরেও রাস্তায় রাস্তায় গতকাল দুপুরের পর থেকে পুলিশের তল্লাশি জোরদার করা হয়। এ ছাড়া দেশের কয়েকটি জায়গা থেকে কোনো ঘোষণা ছাড়াই গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যায়।
বাধাবিপত্তির মুখেই বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী গতকাল দুপুর থেকে জড়ো হতে থাকেন নয়াপল্টনে তাঁদের সমাবেশস্থলে। তাঁরা একপর্যায়ে সেখানে মিছিল করেন। তবে গতকাল সন্ধ্যায় পুলিশের জলকামান ও রায়ট কার নয়াপল্টনে যাওয়ার পর সেখানে জড়ো হওয়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের পুলিশ সরিয়ে দেয়। গতকাল রাতে সমাবেশস্থলে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী আবার জড়ো হন।
গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত
বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন ধরেই ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকাসহ দেশের ১৮টি জেলায় ৪২৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই গ্রেপ্তার হয়েছেন ২০৫ জন। ঢাকায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের গতকাল আদালতে হাজির করে কারাগারে পাঠানো হয়। বাকি ১৭টি জেলায় ২২১ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। উত্তরে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, রংপুর থেকে শুরু করে দক্ষিণ–পশ্চিমে খুলনা, মধ্যাঞ্চল ময়মনসিংহ, ঢাকাসহ ১৮টি গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হয়েছে গত ২৪ ঘণ্টায়। গত দুই দিনে এ নিয়ে সারা দেশে বিএনপির ৮৩৯ জন নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলো।
বিএনপি অভিযোগ করে আসছে, তাদের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে দমননীতির অংশ হিসেবে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হচ্ছে। পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, পুরোনো নাশকতার মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তবে বিএনপি বলেছে, বিএনপির নেতা-কর্মীদের পুরোনো বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে।
রাজধানী ঘিরে তল্লাশিচৌকি
ঢাকার চারটি প্রবেশমুখসহ আশপাশের বিভিন্ন স্থানে তল্লাশিচৌকিতে সাধারণ মানুষও বাধার মুখে পড়েছেন। তল্লাশিচৌকিগুলোয় যানবাহন থামিয়ে যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এসব তল্লাশিচৌকিতে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদাপোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও অংশ নেন।
ঢাকার প্রবেশমুখ গাবতলী সেতুর মুখ, উত্তরার আবদুল্লাহপুর, পরে দুপুর থেকে উত্তরার কামারপাড়া, শ্যামপুরের পোস্তগোলা সেতু ও বাবুবাজার সেতু, নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডে, ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের সুলতানা কামাল ব্রিজের মুখে নিরাপত্তাচৌকি বসিয়ে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। তারা ঢাকার বাইরে থেকে আসা যানবাহন থামিয়ে ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তল্লাশি চালায়। এ সময় পুলিশ ব্যাগ খুলে তল্লাশি চালায় ও যাত্রীদের মুঠোফোন পরীক্ষা করে দেখে।
শ্যামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম বলেন, দুষ্কৃতকারী ও মাদক কারবারিরা পোস্তগোলা সেতু দিয়ে যাতে অস্ত্র নিয়ে ঢাকায় ঢুকতে না পারে, সে জন্যই চেকপোস্ট বসানো হয়েছে।
গতকাল র্যাব ২-এর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে গতকাল সকাল থেকে মোহাম্মদপুর, আদাবর, ধানমন্ডি, কলাবাগান, নিউমার্কেট, হাজারীবাগ, শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও এবং তেজগাঁও শিল্প এলাকায় র্যাব টহল দিয়েছে। এ ছাড়া এসব স্থানে নিরাপত্তাচৌকি বসিয়ে তারা যানবাহনে তল্লাশিও চালায়।
এ ছাড়া গতকাল সকাল থেকে ফতুল্লা মডেল থানার পুলিশ ফতুল্লার সাইনবোর্ড এলাকায় নিরাপত্তাচৌকি বসিয়ে বিভিন্ন পরিবহন থামিয়ে যাত্রীদের তল্লাশি চালানোর পাশাপাশি তাঁদের জেরা করে। এ ছাড়া গতকাল সকাল থেকে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে ঢাকাগামী পরিবহনে, সাভারের ইপিজেড, আশুলিয়ার ধউর বেড়িবাঁধ ও পূর্বাচল ৩০০ ফুট, গাজীপুরের চন্দ্রা ত্রিমোড়ে নিরাপত্তাচৌকি বসিয়ে তল্লাশি চালানো হয়।
ঘোষণা ছাড়াই বাস বন্ধ
ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার দিকে কোনো বাস আসছে না গতকাল সকাল থেকে। পূর্বঘোষণা ছাড়া বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা।
ময়মনসিংহ শহরের মাসকান্দা বাস টার্মিনাল এলাকায় গিয়ে প্রথম আলোর প্রতিনিধি দেখতে পান, সেখান থেকে ঢাকার উদ্দেশে কোনো বাস ছেড়ে যাচ্ছে না। মাসকান্দা টার্মিনালে অবস্থিত এনা পরিবহনের টিকিট কাউন্টার বন্ধ ছিল। নগরের আকুয়া বাইপাস, শিকারীকান্দা বাইপাস এলাকায়ও ঢাকাগামী কোনো বাস পাওয়া যায়নি। অথচ স্বাভাবিক সময়ে ওই দুটি বাইপাসে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া, মুক্তাগাছা, শেরপুর ও জামালপুর থেকে ঢাকায় চলাচল করা বাস যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করে।
যাত্রীদের কেউ কেউ বিকল্প উপায়ে ঢাকায় যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার চর ঢাকিরকান্দি গ্রাম থেকে পাঁচজনের একটি দল শরীয়তপুরে যেতে মাসকান্দা টার্মিনালে আসেন। সেখানে বাস না পাওয়ায় বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
টার্মিনালের টিকিট কাউন্টার বন্ধ থাকায় বাস চলাচল বন্ধের কারণ সম্পর্কে এনা পরিবহন কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য ময়মনসিংহের পরিবহন মালিক সমিতির সম্পাদক সোমনাথ সাহার মুঠোফোনে কল দিলে তিনি সাড়া দেননি।
ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ উপলক্ষে বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দলটি।
বুড়িগঙ্গায় খেয়ানৌকা চলাচলেও বাধা দেওয়ার অভিযোগ
বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে কেরানীগঞ্জ থেকে রাজধানীগামী খেয়ানৌকা চলাচল বন্ধ রাখতে মাঝিদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সন্ধ্যায় ছয়টার দিকে কেরানীগঞ্জের জিনজিরা ফেরিঘাট, মান্দাইল বাজারঘাট, আগানগর ঘাট, জিনজিরা টিনপট্টি ঘাটসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় খেয়ানৌকার মাঝিদের নৌকা চলাচলে বাধা দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জিনজিরা বাজারঘাট ও আগানগর গুদারাঘাট এলাকার একাধিক নৌকার মাঝি এই প্রতিবেদককে বলেন, গতকাল সন্ধ্যার দিকে বেশ কয়েকজন লোক এসে তাঁদের হুমকি দিয়ে যান। বলে যান, এখন থেকে আর নৌকা চালানো যাবে না। যে এই নির্দেশ মানবে না, তাকে দেখে নেওয়া হবে। জবাবে মাঝিরা জানিয়েছেন, আরও ঘণ্টাখানেক সময় চালিয়ে নৌকা ঘাটে ভিড়িয়ে রাখবেন। মাঝিরা জানান, যাওয়ার আগে হুমকিদাতা ব্যক্তিরা বলে গেছেন, আগামীকাল সকাল থেকে যেন ঘাটে কোনো নৌকা না থাকে।
এ বিষয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ম ই মামুন বলেন, যানবাহন ও খেয়ানৌকা চলাচল বন্ধ করার নির্দেশনা কাউকে দেওয়া হয়নি। কে বা কারা মাঝিদের এ ধরনের কথা বলেছে, সে ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না।
সাভারে লাঠি হাতে যুবলীগের নেতা-কর্মীদের অবস্থান
বিএনপির নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করে বলছেন, সাভারে মহাসড়কে পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বহনকারী গাড়ি আটকে দেওয়াসহ নেতা-কর্মীদের আটক করছে পুলিশ। অপর দিকে যুবলীগের নেতা-কর্মীরা লাঠি হাতে সাভারের বিভিন্ন এলাকায় গতকাল অবস্থান নিয়েছিলেন।
আশুলিয়া থানা ও সাভার পৌর যুবলীগের নেতা-কর্মীরা গতকাল সাভারের থানা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। পরে তাঁরা একই এলাকায় মহাসড়কের আরিচাগামী লেনের পাশে ছোট আকৃতির প্যান্ডেলে লাঠি হাতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
বিএনপির মহাসমাবেশ নিয়ে কয়েক দিন ধরেই রাজনীতিতে উত্তপ্ত পরিবেশ রয়েছে। তবে বিএনপির নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীনদের দিক থেকে কোনো আক্রমণ না হলে তাঁদের সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগও আজ তাদের সমাবেশ শান্তিপূর্ণ থাকবে বলে বলছে। এরপরও মানুষের মধ্যে দুটি সমাবেশ নিয়ে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা রয়েছে।
বাংলা৭১নিউজ/এবি