বাংলা৭১নিউজ, নুরুল আলম বাকু, চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কেরু এন্ড কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতার কারনে গোটা দর্শনা পৌর এলাকা এখন নোংরা, দুর্গন্ধময় ও অস্বাস্থ্যকর শহরে পরিনত হয়েছে। কেরু এন্ড কোম্পানির জৈবসার তৈরির কাঁচামাল চিনিকল ও ডিষ্টিলারীর বর্জ্য যথাযথভাবে সংরক্ষনের অভাব ও মিলের বর্জ্যপানি নিস্কাশন লাইনের পাইপ ফেটে নোংরা পানি বের হয়ে বিভিন্ন এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় মারাত্মকভাবে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে শহরে বসবাসকারী লক্ষাধিক মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলতে থাকলেও ভ্রুক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। জনমনে প্রশ্ন, যখন সরকার ইটভাটাসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কলকারখানার কারনে পরিবেশ দূষণরোধে নানাবিধ ব্যবস্থা নিতে ব্যস্ত ঠিক সেই মূহুর্তে দেশের একটি রাস্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান কেরু এ্যান্ড কোম্পানির দ্বারা আর কত বেশিমাত্রার দুষণ ঘটলে দূষণরোধে ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ?
জানা যায়, ১৯৩৮ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা দামুড়হুদার দর্শনায় এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ চিনিকল ও ডিষ্টিলারীর সমস্বয়ে কেরু এ্যান্ড কোম্পানী স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের সময় মিলের তরল বর্জ্য ও মিলের যন্ত্রপাতি ধোয়ামোছাসহ আবাসিক এলাকার নোংরা পানি নিষ্কাশনের জন্য চিনিকল থেকে মাথাভাঙ্গা নদী পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পাইপ লাইন বসানো হয়। এ পাইপ লাইনটি দীর্ঘদিনের পুরাতন হওয়ায় প্রায় এক যুগ ধরে পাইপের বিভিন্ন অংশ ফেটে ও ভেঙ্গে গিয়ে মিলের তরল বর্জ্যসহ নোংরা পানি বের হয়ে রেলবাজার সংলগ্ন বদের মা’র গর্ত, দক্ষিন দিকের আশুর গর্র্ত, মোছাদ্দারুল মিয়ার পুকুর ভর্তি হয়ে ও পুরাতন বাজার হিন্দু পাড়ার রাস্তাসহ বসতবাড়ির উঠানে ভর্তি হয়ে গোটা এলাকায় মারাত্মক দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। এ অবস্থা প্রকট আকার ধারন করলে কয়েক বছর আগে চিনিকল কর্তৃপক্ষ টেন্ডারের মাধ্যমে পাইপ লাইনটি মেরামত করে। মেরামতকালে চিনিকলের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দুর্নীতির সুযোগে নিয়োজিত ঠিকাদার নি¤œমানের নির্মানসামগ্রী ব্যবহার করে পাইপলাইনটির সংস্কার কাজ শেষ করে বিল উত্তোলন করে। ফলে সংস্কারের কিছুদিনের মাথায় আবারোও পাইপ লাইনের বিভিন্ন স্থানে ফাঁটল ধরে আগের অবস্থায় ফিরে গিয়ে অসহনীয় দুর্গন্ধে অতিষ্ট করে তুলেছে দর্শনা শহরবাসীকে।
এছাড়া কয়েক বছর আগে কেরু কর্তৃপক্ষ মিল এরিয়ায় বড় আকারের দুইটি খোলা জলাধার নির্মান করে সেখানে জৈব সারের কাঁচামাল মিলের বর্জ্য রাখার ব্যবস্থা করে। খোলা অবস্থায় থাকার কারনে এ বর্জ্যের দুর্গন্ধে রাতদিন এলাকার বাতাস ভারি হয়ে থাকে। দিনের বেলা যত রোদ পড়ে এর পানি শুকিয়ে দুর্গন্ধের মাত্রা তত বাড়তে থাকে। এ দুর্গন্ধের কারনে কেরু এলাকা ছাড়াও শহরের আনোয়ারপুর, শান্তিপাড়া, পাঠানপাড়া, মোবারকপাড়া, ইসলামবাজার, পুনাতনবাজার, মহম্মদপুর, আজমপুর মহল্লাসহ গোটা শহর জুড়ে মারাত্মকভাবে বায়ুদুষন ঘটছে। ফলে বায়ুদুষনজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এলাকায় বসবাসকারী মানুষ।
কয়েকদিন আগে সরেজমিনে কেরুজ বর্জ্যপানির ট্যাংক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বৃষ্টির কারনে একটি ট্যাংকে রক্ষিত নোংরা পানি উপচে গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। পাশের সিজনাল ব্যরাকের সামনের মাঠ ও আশপাশ এলাকা এখন বর্জ্য পানির ট্যাংকে পরিনত হয়েছে। ছড়িয়ে পড়া এই পানিতে জন্ম নেয়া কোটি কোটি মশা-মাছি দেখে মনে হয়েছে কেরু কোম্পানি চিনি ও স্পিরিট উৎপাদনের পাশাপাশি মশা-মাছিরও উৎপাদন শুরু করেছে। এসময় এ এলাকায় বসবাসকারী আনোয়ার পুরের গৃহবধু হাফিজা(৭০), রেজাউল(৪০), হাসপাতালপাড়ার নুর ইসলাম, মিলের কোয়ার্টারের বাসিন্দা আমেনা খাতুন(৫৫)সহ বেশ কয়েকজন জানান, বৃষ্টির কারনে পুকুরের বর্জ্য পানি উপচিয়ে পুরো এলাকা প্লাবিত হয়ে একাকার হয়ে গেছে। এ নোংরা পানির দুর্গন্ধ ও সেইসাথে পানিতে জন্ম নেয়া মশা-মাছির কারনে এখানে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। দিনের বেলায়ও মশারি ছাড়া ছেলেমেয়েরা থাকতে পারে না। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে এ বিষাক্ত ও নোংরা পানি জমে থাকার কারনে বিভিন্ন গাছপালা মরে যাচ্ছে। এ ব্যপারে কেরু অফিসে বারংবার অভিযোগ করেও কোন ফল হয়নি। এলাকায় বাড়ি হওয়ার কারনে শত অসুবিধা হলেও বাধ্য হয়েই মুখ বুজে সব সহ্য করছি।
এসময় ক্লাস শেষে বর্জ্যপানির ট্যাংকের পাশের রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে আনোয়ারপুর, লোকনাথপুর, দুধপাতিলার ও হঠাৎপাড়ার বাসিন্দা দর্শনা ডিএস মাদরাসার ছাত্রী হ্যাপি, এ্যানি, সুরাইয়া, সাথী, আদুরী, সাবিনা, সাগরী, কেরুজ হাই স্কুলের শিক্ষার্থী আবদুল্লা আল সাহাব, আনোয়ার, মুস্তাফিজ, সোহাগ রাশেদ, নাহিদ,মুজাহিদুল, মিনা, রোকেয়া, আফিয়া, আশা, ফারজানা, রিমি, উর্মি, সাদিয়া বলে, আমরা রোজ এ রাস্তাটি দিয়েই স্কুল ও মাদরাসায় যাতায়াত করি। এখানে আসলে রাস্তার দু’পাশের ট্যাংকের নোংরা পানির দুর্গন্ধে আমাদের খুবই অসুবিধা হয়। অনেক সময় বমি ওঠার উপক্রম হয়। এ রাস্তাটি ছাড়া অন্য রাস্তায় অনেক দুরত্বের কারনেই এখান দিয়েই আমাদের যাতায়াত করতে হয়। বিশেষ করে রোদ্র ও বৃষ্টির সময় বেশি অসুবিধা হয়।
এ সমস্যা ছাড়াও মিলের চিমনির ছাই ও বিষাক্ত ধোঁয়ায় পরিবেশদূষণের ব্যাপারে কেরু এ্যান্ড কোম্পানির ব্যাবস্থাপনা পরিচালক এবিএম আরশাদ হোসেনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, আমরা সব বিষয়ে নিয়ম মেনেই চলি। আমাদের কারনে পরিবেশষদুষণ ঘটে না। আর তা হলেতো পরিবেশবাদিীরা আমাদের বলতেন।
ইতিপুর্বে এ সমস্যার সাথে মিলের চিমনির ছাই ও বিষাক্ত ধোঁয়ায় পরিবেশদূষণের বিষয়ে বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে একাধিকবার সংবাদ প্রকাশিত হলেও টনক নড়েনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃৃপক্ষের। তাই জনমনে প্রশ্ন, দেশের একটি রাস্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান কেরু কোম্পানীর দ্বারা আর কত বেশি মাত্রার পরিবেশদুষণ ঘটলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন কেরু এ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বাংলা৭১নিউজ/জেএস