বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের সাথে সম্পৃক্তরা বলছেন, গল্প বলার ক্ষেত্রে তাদের স্বাধীনতা সীমিত হয়ে গেছে। তারা যেভাবে সিনেমার গল্প বলতে চান, সেটি অনেক সময় করা যায় না।
সম্প্রতি ‘হাওয়া’ সিনেমায় শালিক পাখিকে কেন্দ্র করে মামলার উদ্যোগ এবং ‘শনিবার বিকেল’ নামে আরেকটি সিনেমা সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র না পাওয়ার কারণে এসব প্রশ্ন সামনে এসেছে।
‘শনিবার বিকেল’ নামের একটি সিনেমা সেন্সর বোর্ডের আপত্তির কারণে সাড়ে তিন বছর যাবত ঝুলে আছে।
‘হাওয়া’ সিনেমার দৃশ্যে শালিক পাখি খাঁচায় বন্দি করে রাখা এবং মাংস খাওয়ার দৃশ্য সিনেমাটিতে দেখানোয় বন্যপ্রাণী আইন লঙ্ঘন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে জটিলতা কী?
এই সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন সুপরিচিত চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে এটি সেন্সর বোর্ডে জমা দেয়া হয়।
২০১৬ সালে ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলার প্রেক্ষাপটে এই সিনেমাটি তৈরি হয়।
ফারুকী বলছেন, ঢাকার একটি রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছে। চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড একাধিকবার এই সিনেমাটি দেখেছে। এরপর তারা সিনেমাটি আটকে দেয়।
সাধারণত সেন্সর বোর্ড যখন আপত্তি তোলে তখন তারা সুনিদ্দির্ষ্টভাবে বলে দেয় কোন ডায়ালগ, কোন দৃশ্য নিয়ে তাদের আপত্তি।
কিন্তু ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমার ক্ষেত্রে এ ধরনের কিছু জানানো হয়নি বলে উল্লেখ করেন মি. ফারুকী।
“তারা বলে যে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে, ধর্মীয় অস্থিরতা তৈরি করবে – এ রকম ঢালাওভাবে বলা হয়।”
এরপর সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে আপীল করেন পরিচালক। আপীল বোর্ডে সিনেমার পক্ষে আবারো যুক্তি তুলে ধরা হয়।
“এরপর সাড়ে তিন বছর পার হয়ে গেছে। এখনো আমরা কিছু জানতে পারি নি,” বলেন মি. ফারুকী।
কী বলছে সেন্সর বোর্ড?
‘শনিবার বিকেল’ সিনেমাটি কেন আটকে আছে- এ বিষয়ে সেন্সর বোর্ডের দিক থেকে কোন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে সেন্সর বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এটি এখন আপিল পর্যায়ে আছে।
“সরকার কিন্তু বলে নাই যে ছবি ছাড়বে না। মন্ত্রণালয় ভাবছে কী করা যায়,” বলেন সে কর্মকর্তা।
কেন সিনেমাটি সেন্সর বোর্ডে আটকে দেয়া হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে সে কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে বলেন, সিনেমাটির কাহিনী অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে।
“হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলার ঘটনাটি খুবই স্পর্শকাতর। সেখানে সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশের একটা এনভায়রনমেন্ট ছিল। এসব ঘটনা সিনেমায় উঠে আসেনি।”
যদিও সিনেমাটির পরিচালক মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী বলছেন, সে সিনেমায় ‘হলি আর্টিজান’ শব্দটি কোথাও বলা হয়নি এবং সে ঘটনার সাথে মিল থাকা কোন চরিত্রও ছিল না।
“আমার ফিল্মে হোলি আর্টিজান বলে কোন রেস্টুরেন্ট নাই। হলি আর্টিজানে বাস্তবে যেসব চরিত্র ছিল, সে রকম কোন চরিত্র আমার ফিল্মে নাই। আমার কাজটা একটা ফিকশন,” বলেন মি. ফারুকী। কিন্তু এসব যুক্তি মানতে নারাজ সেন্সর বোর্ডের ওই কর্মকর্তা।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “হোলি আর্টিজানে হামলা নিয়ে যে সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছে, সেটি বেশ ক্লিয়ার। এটা দেখলেই সবাই বুঝবে যে ঘটনাটা কী।” ওই কর্মকর্তা দাবি করেন, সিনেমাটিতে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কোন বার্তা নেই।
গল্প বলার স্বাধীনতা নেই?
বছরের পর বছর ধরে একটি সিনেমা আটকে থাকার বিষয়টি সৃজনশীল চিন্তার জন্য খুবই ক্ষতিকর বলে মনে করেন মি. ফারুকী।
তিনি বলেন, শনিবার বিকেলের মতো একটি সিনেমা যখন আটকে থাকে, তখন অন্যান্য নির্মাতারাও সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করেন।
“সবাই সন্দিহান থাকে যে কী নিয়ে বলতে পারবো আর কী নিয়ে বলতে পারবো না।”
মি. ফারুকীর সাথে একমত পোষণ করেন চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার অধ্যাপক কাবেরি গায়েন।
তিনি মনে করেন, মানুষের কল্পনার জগত যতো বিস্তৃত ঠিক ততটুকুই তার শৈল্পিক স্বাধীনতা হওয়া উচিত। এর কোন সীমারেখা নেই।
তার মতে, একজন শিল্পী বা নির্মাতা কোথায় শেষ করবেন, সেটি তার স্বাধীনতা। গল্প বা চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে তিনি যে কোন চরিত্র সংযোজন বা বিয়োজন করতে পারেন।
“পরিচালক তো বলেননি যে তিনি ঘটনার বিশুদ্ধ ডকুমেন্টারি করেছেন। ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়েও যখন কোন সিনেমা বানানো হয় সেখানেও কল্পিত চরিত্র থাকে।”
“আমরা ওনার সিনেমার সমালোচনা করতে পারি। সিনেমা রিলিজ হবার পরে আমরা বলতে পারি, কোথায় অসম্পূর্ণতা। কিন্তু এই গ্রাউন্ডে তো আমরা সিনেমা বাদ দিতে পারি না,” বলেন অধ্যাপক কাবেরি গায়েন।
সেন্সর বোর্ড তুলে দেবার দাবি
চলচ্চিত্রের সাথে সম্পৃক্ত অনেকেই দাবি তুলেছেন সেন্সর বোর্ড যাতে বিলোপ করা হয়। কারণ, সেন্সরের নামে যখন-তখন সিনেমা আটকে দেয়া কিংবা নানা ধরনের আপত্তি তোলার বিষয়টিকে তারা গ্রহণযোগ্য মনে করেন না।
“আমারা এই সেন্সর সিস্টেমটা চাই না। বাংলাদেশের কোন ফিল্ম মেকার এটা চায় না। এর পরিবর্তে রেটিং সিস্টেম কনটেন্ট চালু হতে পারে,” বলেন মি. ফারুকী।
অর্থাৎ কোন ধরনের কনটেন্ট কোন বয়সের মানুষ দেখতে পারবেন সে ধরনের রেটিং থাকা উচিত। এ রকম রেটিং থাকলে দর্শকরাই ঠিক করে নেবে তারা কোনটি দেখবে আর কোনটি দেখবে না।
অধ্যাপক কাবেরি গায়েনও মনে করেন রেটিং সিস্টেম ভালো হতে পারে।
“আমি সেন্সর শব্দটা পছন্দ করিনা। এর পরিবর্তে যদি বলা হয় অনুমোদন, তাহলে বিষয়টা অনেক পজিটিভ হয়। সেন্সর শব্দটাই আক্রমণাত্মক শব্দ।”
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায়, এ ধরনের বিষয়বস্তু ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে সেন্সরের প্রয়োজন নেই।
বাংলা৭১নিউজ/সূত্র: বিবিসি