দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে চলাচল করছে যানবাহন। আর এতেই বিশ্ব ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনজুড়ে বইছে সুবাতাস। সুন্দরবনে এবার সরাসরি সড়কপথেই যাওয়া যাবে। এতে সুন্দরবনে পর্যটকের সঙ্গে রাজস্ব আয় বাড়বে ৪-৫ গুণ।
জানা গেছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন সড়কপথে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে খুলনার কয়রা ও দাকোপ উপজেলা, বাগেরহাটের মোংলা উপজেলা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা হয়ে সরাসরি যাওয়া যাবে সুন্দরবনে। এটি ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় বিষয়। ফলে ভ্রমণ মৌসুমে সুন্দরবনে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়বে। সমৃদ্ধ হবে সুন্দরবন বিভাগের অর্থনীতি।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় অবস্থিত। ব্রিটিশ ভারত বিভাগের পর বনের দুই-তৃতীয়াংশ পড়েছে বাংলাদেশে, বাকিটা ভারতে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের আওতাধীন সুন্দরবনের মোট আয়তন ৩৫৭৩.২৮ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে খুলনা জেলার সুন্দরবনের আয়তন ২০৭২.২৪ বর্গ কিলোমিটার। বাকিটা সাতক্ষীরা জেলাধীন। এ বন ঘেঁষে সাতক্ষীরার অবস্থান হওয়ায় সড়কপথ দিয়েই সুন্দরবন দেখা যায়।
বাংলাদেশের ৬টি জেলাজুড়ে সুন্দরবন বিস্তৃত হলেও একমাত্র সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জে এলাকা থেকে সরাসরি দেখা যায় সুন্দরবনের সবুজ আবহ। মুন্সিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালেই নদীর ওপারে চোখে পড়ে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ‘ব্র্যান্ড’ সুন্দরবন।
সুন্দরবনকে পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয়, দৃষ্টিনন্দন ও আনন্দদায়ক করে তুলেছে সুন্দরবন ঘিরে মুন্সিগঞ্জ এলাকায় গড়ে ওঠা আকাশলীনা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার, মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত, কলাগাছিয়া ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার, দোবেকী ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার, ক্যারাম মুরা ম্যানগ্রোভ ভিলেজ, ক্যারাম মুরা পাখি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, কৈখালী সীমান্ত ও পাঁচ নদীর মোহনা, উড়ালমন আদিবাসী গ্রাম ও নৌকা ভ্রমণ সাইট এবং শিয়ালকুনি বনায়ন।
এছাড়া পর্যটকদের থাকার জন্য রয়েছে মুন্সিগঞ্জের কলবাড়িতে অবস্থিত বর্ষা রিসোর্ট ও ট্যুরিজম সেন্টার। আবাসিক সুবিধা রয়েছে মুন্সিগঞ্জের আকাশলীনা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারেও। একইসঙ্গে মুন্সিগঞ্জে রয়েছে সুশিলনসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিলাসবহুল রিসোর্ট। এখানে স্বল্প খরচে পর্যটকদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এম এ হাসান জানান, সুন্দরবন একটি বিশ্ব ঐতিহ্য। পর্যটকদের কাছে সুন্দরবন খুবই আকর্ষণীয়। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এখন ঢাকা থেকে সকালে এসে সুন্দরবন ঘুরে বিকেলে চলে যেতে পারবেন পর্যটকরা। এখানে পর্যটকদের জন্য সুন্দরবন ঘোরার সব ধরনের সুযোগ সুবিধা রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আপাতত তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশের পাস বন্ধ রয়েছে। কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে মৌসুমের আগেই পাস ইস্যু শুরু হবে।
২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রায় তিন কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সাতক্ষীরা রেঞ্জের সুন্দরবনে পর্যটকের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। রাজস্ব আদায়ও বেড়ে দ্বিগুণ হবে। তবে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।
সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে সুন্দরবনে পর্যটক এসেছে এক লাখ ২০ হাজার জন। এখান থেকে সুন্দরবন বিভাগের রাজস্ব আয় হয়েছে এক কোটি ২৫ লাখ টাকা। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সুন্দরবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। পর্যটকদের সংখ্যা যেমন বাড়বে তেমনি রাজস্বও বাড়বে বলে এই বন কর্মকর্তা জানান।
তিনি বলেন, পর্যটকদের চাপ সামলাতে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল, হারবাড়িয়া, কটকা, কচিখালী ও দুবলা এবং পশ্চিম বিভাগের হিরন পয়েন্ট ও কলাগাছিয়া এই সাতটি ইকোট্যুরিজমের সঙ্গে নতুন আরও চারটি ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র যোগ করা হচ্ছে।
সুন্দরবন ইকো ট্যুরিজম প্রকল্পের আওতায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিক, শরণখোলা রেঞ্জের আলী বান্দা এবং পশ্চিম বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের শেখের টেক ও কালাবগিতে নতুন এই ট্যুরিজমগুলো নির্মাণ করা হবে বলেও জানান তিনি। এসব ইকো ট্যুরিজমে পর্যটকদের সুব্যবস্থার জন্য গোলঘর, ফুটট্রেলার, পাবলিক শৌচাগার, ওয়াচ টাওয়ার ও রাস্তা করা হবে।
সুন্দরবনের ট্যুরিজম ব্যবসায়ীদের নেতা নাজমুল আযম ডেভিড বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় অধিকাংশ সময় পর্যটকরা সুন্দরবনে আসতে চাইতো না। এখন যেহেতু পদ্মা সেতু চালু হয়েছে তাই সেই চিরচেনা চিত্র একেবারেই পাল্টে যাবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার দূরত্ব কমে সহজ হওয়ায় এখন পর্যটকদের আকর্ষণও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
পূর্ব সুন্দরবনের করমজল বণ্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, এই বনে বাঘ, হরিণ, বানরসহ ৩১৫ প্রজাতির বণ্যপ্রাণী এবং সুন্দরী, বাইন, গরানসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।
মূলত এসব দেখতেই প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভ্রমণ পিপাসুরা ছুটে আসেন। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় মাঝে মাঝে মৌসুমেও পর্যটকদের ভাটা পড়ত। এখন সেতু চালু হওয়ায় পর্যটক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবনের এ খাত থেকে রাজস্ব আয় হবে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ