শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১৯ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম
চাচাকে বাবা বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিসিএস ক্যাডার! হাইকোর্টের নতুন রেজিস্ট্রার হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী লামায় অগ্নিসংযোগ: ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে উপদেষ্টা-প্রশাসন নসরুল হামিদের ৩৬ কোটি টাকার সম্পদ, অস্বাভাবিক লেনদেন ৩১৮১ কোটি তিন উপদেষ্টাকে বিপ্লবী হতে বললেন সারজিস আলম জামিন নামঞ্জুর, কারাগারে আওয়ামী লীগ নেতা বলরাম ফায়ার ফাইটার নিহতের ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা কোরিয়া থেকে ৬৯৩ কোটি টাকার এলএনজি কিনবে সরকার সাভারে বন্ধ টিএমআর কারখানা চালুর নির্দেশনা উপদেষ্টার দুদকের সাবেক কমিশনার জহুরুল হকের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু কনস্টাসকে ধাক্কা দেওয়ায় কোহলিকে আইসিসির শাস্তি শেখ হাসিনা-শেখ রেহানার বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করার দাবি ফখরুলের ১১ বছর পর দেশে ফিরছেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক যারা নির্বাচনকে বিতর্কিত করেছেন, তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত প্রাণ এএমসিএলের ৩২ শতাংশ লভ্যাংশ অনুমোদন সেতু মন্ত্রণালয় থেকে বাদ যাচ্ছে ১১১৮৬ কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বিমানের সিটের নিচে মিলল ২০ সোনার বার, যাত্রী আটক ‘পিলখানা হত্যায় নিরপেক্ষ থেকে ষড়যন্ত্র চিহ্নিত করা হবে’ চোখের জলে এক বীরকে বিদায় দিল ফায়ার সার্ভিস

জাপান যেভাবে ‘বাঙালির চিরকালের নিঃস্বার্থ বন্ধু’

বাংলা৭১নিউজ,ডেস্ক
  • আপলোড সময় সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
  • ৫৬ বার পড়া হয়েছে

প্রয়াত হিরোহিতো জাপানের সম্রাট থাকাকালে একবার বলেছিলেন, ‘যতদিন জাপান থাকবে, বাঙালি খাদ্যাভাবে, অর্থকষ্টে মরবে না। জাপান হবে বাঙালির চিরকালের নিঃস্বার্থ বন্ধু।” সম্রাট হিরোহিতোর এই বক্তব্য ছিল একজন বাঙালির প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ। এই বাঙালি ব্যক্তিটির জন্ম বাংলাদেশের কুষ্টিয়াতে।

রাধা বিনোদ পাল ছিলেন একজন বাঙালি শিক্ষক ও আইনজীবী, যার জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া ও রাজশাহীতে, যদিও তিনি দেশ বিভাগের পর ভারতের নাগরিক হয়েছিলেন।

টোকিওর চিয়োদা অঞ্চলে ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ইয়াসুকুনি স্মৃতিসৌধ, যেটি প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষের স্মৃতির সম্মানে, যারা জাপানের হয়ে অথবা জাপানের বিপক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে অথবা যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কোনো ধরণের সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেছেন।

এখানে একটি মোটে স্মৃতিস্তম্ভ ব্যতিক্রমী, যার স্মরণে এটি তৈরি, তিনি একজন জীবিত ব্যক্তি। রাধা বিনোদ পালই হলেন সেই ব্যক্তি।

স্মারক স্তম্ভ তৈরির অনেক বছর পর ১৯৬৭ সালে তার মৃত্যু হয়।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ভারতীয় নাগরিককে জাপানে জাতীয় বীরদের পর্যায়ের সম্মাননা দেয়া হয়। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ২০০৭ সালে তিনদিনের জন্য ভারত সফরে এসে রাধা বিনোদ পালের ছেলে প্রশান্ত পালের সাথে দেখাও করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যেই আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের সম্মুখীন করা হয়, সেই টাইব্যুনালের এগারো জন বিচারকের একজন ছিলেন রাধা বিনোদ পাল।

ঐ ট্রায়ালে এগারোজন বিচারকের মধ্যে শুধুমাত্র রাধা বিনোদ পালই জাপানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে রায় দিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে জাপানের পক্ষে মি. পালের রায়ের জন্যই ঐ ট্রায়ালের কয়েকজন বিচারক প্রভাবিত হয়ে তাদের রায় কিছুটা নমনীয় করেছিলেন।

কুষ্টিয়া থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য

রাধা বিনোদ পালের জন্ম ১৮৮৬ সালে, কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ছালিমপুর গ্রামে।

কুষ্টিয়া জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে ‘কুষ্টিয়ার ইতিহাস’ নামে একটি বই লিখেছেন মুহম্মদ এমদাদ হাসনায়েন এবং তার স্ত্রী সারিয়া সুলতানা, যেখানে উঠে এসেছে রাধা বিনোদ পালের শৈশবের ঘটনা।

এমদাদ হাসনায়েন বলেন, “রাধা বিনোদ যখন শিশু, তখনই তার বাবা সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। রাধা বিনোদের শৈশব ও কৈশোর কাটে চরম দারিদ্রের মধ্যে। কৈশোরের একটা বড় সময় আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রিত থেকে পড়ালেখা করতে হয় তাকে।”

১৯০৩ সালে এন্ট্রান্স ও ১৯০৫ সালে এফএ পাস করেন রাজশাহী থেকে। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে অনার্স পাস করেন ১৯০৮ সালে।

মি. পালের কর্মজীবনের শুরুটা হয় ময়মনসিংহে, আনন্দমোহন কলেজের গণিতের শিক্ষক হিসেবে।

শিক্ষকতার পাশাপাশি আইন বিষয়ে পড়াশোনাও চালিয়ে যান, দায়িত্ব পালন করেন কলকাতা ল কলেজের অধ্যাপক হিসেবেও।

১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

“রাধা বিনোদ ১৯৪৬ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ছালিমপুরে ফিরে আসেন। কিন্তু সে বছরই এপ্রিল মাসে তিনি আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পান”, বলেন এমদাদ হাসনায়েন।

আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই বিজয়ী মিত্রশক্তি সিদ্ধান্ত নেয় যে, যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধের সময় সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের জন্য প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, সেনা কর্মকর্তা ও যুদ্ধাপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট আরো কিছু ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনবে।

১৯৪৫ সালে লন্ডন সনদ মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা আন্তর্জাতিক মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রপক্ষে থাকা দেশগুলো ছাড়াও গ্রিস, ডেনমার্ক, পোল্যান্ড, তৎকালীন যুগোস্লাভিয়া সহ অন্তত ২০টি দেশ ঐ চুক্তির অংশ ছিল।

নুরেমবার্গ ট্রায়ালের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করেই পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা করা হয় ট্রাইব্যুনাল ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ফার ইস্ট, যেটি টোকিও ট্রায়াল হিসেবেই পরিচিত।

টোকিও ট্রায়ালে এগারো জন বিচারককে অংশগ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।

সেই এগারো জন বিচারকের মধ্যে একজন ছিলেন রাধা বিনোদ পাল। বাকি দশ জন বিচারক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড ও ফিলিপিন্সের নাগরিক।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলসের ইতিহাসের অধ্যাপক বিনয় লাল বলেন, “ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে, সেসময় এমন একজন বিচারককে এই ট্রাইব্যুনালের অংশ রাখা হয়েছিল, কারণ ভারত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের অংশগ্রহণ ছিল।”

“কোন কোন দেশ থেকে বিচারক জুরি বোর্ডে রাখা হবে, বিবিধ যুক্তির ভিত্তিতে তা নির্ধারণ করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডিং অফিসার জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থার”, বলেন মি. লাল।

১৯৪৬ সালের পোস্টডাম সনদ মি. ম্যাকআর্থারকে বিচারক নির্বাচনের এই ক্ষমতা দিয়েছিল।

“পোস্টডাম সনদে স্বাক্ষর করা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও চীন জাপানকে ‘শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পণ’ করার দাবি জানায় এবং ঘোষণা দেয় যে ‘যুদ্ধাপরাধীদের কঠোর বিচার’ করা হবে। ট্রাইব্যুনালও শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হওয়া যুদ্ধাপরাধ বিবেচনা না করে ১৯৩১ সালে জাপানের মাঞ্চুরিয়া দখল থেকে শুরু করে ১৯৪৫ সালের অপরাধ পর্যন্ত সব যুদ্ধাপরাধের বিচার করার এখতিয়ার নেয়”, বলেন অধ্যাপক বিনয় লাল।

এই ট্রায়ালে অভিযুক্তদের তালিকা থেকে জাপানের তৎকালীন সম্রাট হিরোহিতোকে বাদ দেয়া হয়েছিল।

নুরেমবার্গ ট্রায়ালে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যে ধরণের অভিযোগ আনা হয়েছিল, টোকিও ট্রায়ালেও অভিযোগের ধরণ একইরকম ছিল।

অভিযুক্ত জাপানি শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তিন ধরণের অপরাধের অভিযোগ আনা হয় – শান্তিবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ।

বিচারে রাধা বিনোদ পালের ভূমিকা

অধ্যাপক বিনয় লাল বলেন, ট্রাইব্যুনালের অধিকাংশ বিচারক যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং শান্তিবিরোধী অপরাধের দায়ে জাপানের নেতাদের দোষী সাব্যস্ত করলেও রাধা বিনোদ পালের রায় ছিল তাদের বিপরীত।

এমদাদ হাসনায়েন তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে: “ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে রাধা বিনোদ পালের প্রধান প্রশ্ন ছিল, যারা জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তাদের নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন করার এবং নিজেদের শর্ত অনুযায়ী পরাজিত শত্রুদের বিচার করার নৈতিক অধিকার আছে কি না।”

“নেদারল্যান্ডস ও ফিলিপিন্সের একজন বিচারপতি রাধা বিনোদকে যদিও নৈতিক সমর্থন জুগিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়কে অনেকটা বাধ্য হয়েই মেনে নিয়েছিলেন।”

রাধা বিনোদ পালের বক্তব্য ছিল, ট্রায়ালে জাপানকে যেসব অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হচ্ছে, অভিযোগকারী পক্ষরা নিজেরাই সেসব অপরাধ সংঘটন করে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ।

বিচারক পাল তার রায়ে মন্তব্য করেন যে তৎকালীন সময়ে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সের মত যেসব দেশের উপনিবেশ ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে, সেসব দেশের মানুষের ওপর যুদ্ধকালীন সময় ছাড়াও তারা শান্তি বিরোধী ও মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে।

এছাড়া জাপানের বিরুদ্ধে আনা অপরাধের অভিযোগে অপরাধের মাত্রা অতিরঞ্জিত করেও উপস্থাপন করা হয়েছে বলেও তার বিচারে মত প্রকাশ করেন বিচারক পাল, বলেন অধ্যাপক বিনয় লাল।

মি. লাল বলেন, “মজার বিষয় হল, রাধা বিনোদ পালের ৮০০ পৃষ্ঠার রায়টি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই জাপানে সেটিকে নিষিদ্ধ করে অধিগ্রহণকারী মার্কিন বাহিনী।”

“আর ঠিক যেদিন মার্কিন বাহিনী জাপান ছেড়ে যায়, ঠিক সেদিন রায়টি জাপানে প্রকাশিত হয়।”

পরবর্তীতে রাধা বিনোদ পাল দু’বার জাপানে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে সফর করেন।

১৯৬৬ সালের অক্টোবরে জাপানের সম্রাট হিরোহিতো তাকে জাপানের সর্বোচ্চ অ্যাকাডেমিক খেতাব ‘ফার্স্ট অর্ডার অব সেক্রেড ট্রেজার’ প্রদান করেন।

এমদাদ হাসনায়েন ও সারিয়া সুলতানা তাদের ‘কুষ্টিয়ার ইতিহাস’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, “‘টোকিও ট্রায়াল’ ধাপে এই বাঙালি বিচারকের দৃঢ় অবস্থানের কারণেই জাপান অনেক কম ক্ষতিপূরণের উপর বেঁচে গিয়েছিলো। নয়ত যে ক্ষতিপূরণের বোঝা মিত্রপক্ষ ও অন্য বিচারকরা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তার দায় এখন পর্যন্ত টানতে হত জাপানকে।”

বাংলা৭১নিউজ/সূত্র: বিবিসি

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরও সংবাদ
২০১৫-২০২৪ © বাংলা৭১নিউজ.কম কর্তৃক সকল অধিকার সংরক্ষিত।
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com