আগামীকাল ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসা দিবসের উৎপত্তির গল্পটি আমরা প্রায় সবাই জানি। তবুও এ দিনটি যার নামে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে, তাকে উষ্ণতার এ দিনে মনে না করলেই নয়। মূলত ভালোবাসাকে কেন্দ্র করেই মানুষের জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
ভ্যালেন্টাইন ডে’র গল্পটি শুরু হয় অত্যাচারী রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লাডিয়াস এবং খ্রিস্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে দিয়ে। তৃতীয় শতকে সম্রাট ক্লাডিয়াস সমগ্র রোমানবাসীকে ১২জন দেব-দেবীর আরাধনা করার নির্দেশ দেন। সেসময় খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা ছিলো কাঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি খ্রিস্টানদের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্য শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো।
এদিকে, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন খ্রিস্টধর্মের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। মৃত্যুর ভয়ে তিনি খ্রিস্টধর্ম পালনে পিছপা হননি। কিন্তু যা হবার তাই হলো, সম্রাট ক্লাডিয়াস তাকে কারাগারে বন্দি করে রাখলেন।
ভ্যালেন্টাইনের জীবনের শেষ সপ্তাহগুলোতে ঘটলো এক জাদুকরী ঘটনা। তিনি যে কারাগারে বন্দি ছিলেন সেখানকার কারারক্ষী ভ্যালেন্টাইনের প্রজ্ঞা দেখে মুগ্ধ হন। কারারক্ষী ভ্যালেন্টাইনকে জানান, তার মেয়ে জুলিয়া জন্মগতভাবেই অন্ধ, ভ্যালেন্টাইন তাকে একটু পড়ালেখা করাতে পারবেন কিনা।
জুলিয়া চোখে দেখতে পেতেন না, কিন্তু তিনি ছিলেন খুব বুদ্ধিমতী। ভ্যালেন্টাইন জুলিয়াকে রোমের ইতিহাস পড়ে শোনাতেন, পাটিগণিত শেখাতেন। মুখে মুখে প্রকৃতির বর্ণনা ফুটিয়ে তুলতেন ও ঈশ্বর সম্পর্কে বিস্তারিত বলতেন। জুলিয়া ভ্যালেন্টাইনের চোখে দেখতেন অদেখা পৃথিবী। তিনি ভ্যালেন্টাইনের জ্ঞানকে বিশ্বাস করতেন, ভ্যালেন্টাইনের শান্ত প্রতিমূর্তি ছিলো জুলিয়ার শক্তি।
একদিন জুলিয়া ভ্যালেন্টাইনকে জিজ্ঞেস করেন-
– ভ্যালেন্টাইন, সতিই কি ঈশ্বর আমাদের প্রার্থনা শোনেন?
– হ্যাঁ, তিনি সবই শোনেন।
– জানো, রোজ সকাল আর রাতে আমি কি প্রার্থনা করি? প্রার্থনা করি, যদি আমি দেখতে পেতাম। তোমার মুখ থেকে আমি যা যা দেখেছি তার সবই আামি দেখতে চাই ভ্যালেন্টাইন।
– আমরা যদি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি তাহলে তিনি আমাদের জন্য যা ভালো তার সবই করেন। ভ্যালেন্টাইন উত্তর দিলেন।
এভাবে প্রার্থনা করতে করতে একদিন জুলিয়া ঠিকই তার দৃষ্টি ফিরে পেলেন। কিন্তু সময় ঘনিয়ে এসেছে ভ্যালেন্টাইনের। ক্রদ্ধ ক্লাডিয়াস সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দিন ধার্য করলেন। দিনটি ছিলো ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২৭০ অব্দ।
মৃত্যুর আগের দিন ভ্যালেন্টাইন জুলিয়াকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠির শেষে লেখা ছিলো, ফ্রম ইউর ভ্যালেন্টাইন। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যু কার্যকর হয় ও তাকে বর্তমান রোমের প্রক্সিদেস গির্জার স্থলে সমাহিত করা হয়।
কথিত রয়েছে, ভ্যালেন্টাইনের কবরের কাছে জুলিয়া একটি গোলাপি ফুলে ভরা আমন্ড গাছ লাগান। সেখান থেকে আমন্ড গাছ স্থায়ী প্রেম ও বন্ধুত্বের প্রতীক।
পরবর্তীতে ৪৯৬ অব্দে পোপ প্রথম জেলাসিউস ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভ্যালেন্টাইন ডে-তে প্রেমিক-প্রেমিকা ছাড়াও বিভিন্ন সম্পর্কের মধ্যে বিনিময় হয় প্রেম, স্নেহ ও ভক্তি। হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন’স ডে।
ভালোবাসা দিবস
প্রথম দিকে এটি সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন্স নামক একজন অথবা দুজন খ্রিষ্টান শহিদকে সম্মান জানাতে খ্রিষ্টধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছিল, পরবর্তীতে লোক ঐতিহ্যের ছোঁয়ার মধ্যে দিয়ে এটি বিভিন্ন দেশে আস্তে আস্তে প্রেম ও ভালোবাসার সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক একটি আনুষ্ঠানিক দিবসে পরিণত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হয়ে থাকলেও অধিকাংশ দেশেই দিনটি ছুটির দিন নয়।
২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’স নামে একজন খৃষ্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ছিলেন। ধর্ম প্রচারের অভিযোগে তৎকালীন রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাকে বন্দী করেন। কারণ তখন রোমান সাম্রাজ্যে খৃষ্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দী অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এতে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। আর তাই তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিন ১৪ই ফেব্রুয়ারি ছিল। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেন্টাইন’স স্মরণে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন’ দিবস ঘোষণা করেন। খৃষ্টানজগতে পাদ্রী-সাধু সন্তানদের স্মরণ ও কর্মের জন্য এ ধরনের অনেক দিবস রয়েছে। যেমন: ২৩ এপ্রিল – সেন্ট জজ দিবস, ১১ নভেম্বর – সেন্ট মার্টিন দিবস, ২৪ আগস্ট – সেন্ট বার্থোলোমিজম দিবস, ১ নভেম্বর – আল সেইন্টম দিবস, ৩০ নভেম্বর – সেন্ট এন্ড্রু দিবস, ১৭ মার্চ – সেন্ট প্যাট্রিক দিবস।
পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্মদিনের উৎসব, ধর্মোৎসব সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য। তাই গির্জা অভ্যন্তরেও মদ্যপানে তারা কসুর করে না। খৃস্টীয় এই ভ্যালেন্টাইন দিবসের চেতনা বিনষ্ট হওয়ায় ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ভ্যালেইটাইন উৎসব নিষিদ্ধ করা হয়। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিকভাবে এ দিবস উদ্যাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবস প্রত্যাখ্যাত হয়। সম্প্রতি পাকিস্তানেও ২০১৭ সালে ইসলামবিরোধী হওয়ায় ভ্যালেন্টাইন উৎসব নিষিদ্ধ করে সেদেশের আদালত। বর্তমানকালে, পাশ্চাত্যে এ উৎসব মহাসমারোহে উদ্যাপন করা হয়। যুক্তরাজ্যে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড ব্যয় করে এই ভালোবাসা দিবসের জন্য কার্ড, ফুল, চকোলেট, অন্যান্য উপহারসামগ্রী ও শুভেচ্ছা কার্ড ক্রয় করে এবং আনুমানিক প্রায় ২.৫ কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশেও বর্তমানে এই দিবস পালন খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে তরুণ সমাজের কাছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির মিশ্রণে ভিন্নভাবে “বিশ্ব ভালোবাসা দিবস” নামে এটি পালিত হয়। বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৩ই ফেব্রুয়ারি তারিখে বসন্ত উৎসব তথা “পহেলা ফাল্গুন” উদযাপিত হয়। তার ঠিক পরের দিনই ভালোবাসা দিবস পালন করা হয় বিধায় অনেকের কাছেই এই দিবসটি বেশ উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। তবে কখনো কখনো অধিবর্ষের কারণে পহেলা ফাল্গুন এবং ভালোবাসা দিবস একই দিনে পালিত হয়। তখন বাংলাদেশের অধুনা তরুণ সমাজের কাছে আরও ভিন্ন উপায়ে উদ্যাপন করতে উৎসাহিত হয়। এই “ভালোবাসা দিবস” পালন করার আয়োজন হিসেবে সামাজিক গণমাধ্যম খুব বড় একটা ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন ফুলের দোকান, ফ্যাশন হাউজ, উপহারএর দোকান, বেকারি ও ফাস্ট ফুড দোকানগুলোতে বিশেষ কিছু অফার চালু রাখে।
তাছাড়া টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলগুলোতে “ভালোবাসা দিবসের গান”, “ভালোবাসা দিবসের নাটক” ইত্যাদি প্রচারিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-“ক্লোজআপ কাছে আসার গল্প”। যেখানে ক্লোজআপ টুথপেস্ট ব্র্যান্ড হতে স্পন্সরকৃত তিনটি রোমান্টিক নাটক প্রচারিত হয়। এই নাটকের মূলগল্পগুলো মূলত সাধারণ জনগণ বা দর্শকেরা নিজেরাই লেখেন, এর মধ্যে মনোনীত তিনটি গল্পের আলোকে এই নাটকগুলি নির্মিত হয়। এই আয়োজনটি দর্শকমহলের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
তবে ভালোবাসা দিবস পালনের জনপ্রিয়তা শুধুমাত্র তরুণ সমাজের কাছেই সীমাবদ্ধ নয়, এই ভালোবাসার উৎসবে সব বয়সের শ্রেণী-পেশার মানুষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাই পরিবারের সদস্যদের সাথে এবং সমলিঙ্গের বন্ধুদের সাথেও উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করেন অনেকেই।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচবি