আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকায় বিশ্বের সব দেশেই এর প্রভাব পড়েছে। চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের সামঞ্জস্য না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে সম্প্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম সাত বছরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
তেলের দামে ভারসাম্য আনতে বিশ্বের তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক এবং তাদের সহযোগী দেশগুলোকে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তারপরও গত বৃস্পতিবারের বৈঠকে ওই দেশগুলো নিজেদের আগের অবস্থানে অনড় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ওপেকসহ তেল উৎপাদনকারী বিভিন্ন দেশ নিজেদের সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারলে আপাতত জ্বালানি তেলের দামের লাগাম টানা সম্ভব হতো। কিন্তু তারা এমন পদক্ষেপ নিতে অনীহা প্রকাশ করেছে। কী পরিমাণ তেল উত্তোলন করা হবে এবং বাজারে কী পরিমাণ তেল আসবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ওপেক। সে কারণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়া বা কমার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
করোনা মহামারির শুরুতে যখন বিশ্বের অর্থনীতি কার্যত থমকে গিয়েছিল, তখন তেলের চাহিদাও তলানিতে নেমে আসে। ফলে ধস নামে অপরিশোধিত তেলের দামে। কিন্তু তেলের দাম ফের বাড়াতে উৎপাদন কমিয়ে আনে সৌদি আরব, রাশিয়াসহ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো।
পরবর্তী দেড় বছরে অর্থনীতি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়ালে তেলের চাহিদা বাড়তে শুরু করে। কিন্তু সে তুলনায় সরবরাহ যথেষ্ট বাড়েনি। ফলে চাহিদার চাপে তেলের দাম বাড়তে বাড়তে ব্যারেলপ্রতি ব্রেন্ট ক্রুডের দাম পৌঁছেছে ৮৫ থেকে ৯০ ডলারের আশপাশে। অন্যদিকে তেলের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থাগুলো প্রাকৃতিক গ্যাসের দিকে ঝুঁকছে।
অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পর ওপেক ও এর সহযোগী দেশগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, চলতি বছরের শেষ দিকে অতিরিক্ত চার লাখ ব্যারেল করে অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করা হবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে খুশি করতে পারেনি।
তিনি উৎপাদন আরও বাড়ানোর কথা বলেছেন। কিন্তু তার এই আহ্বানে সাড়া দেয়নি ওপেক। সম্প্রতি রোমে জি-২০ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর বৈঠকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন বাইডেন। সে সময় ঠিক করা হয়, ওপেক ও এর সহযোগী দেশগুলোর ওপর চাপ বাড়ানো হবে। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। তবে তাতেও কোনো লাভ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বে ও ওপেক জানিয়েছে, তারা তেলের উৎপাদন খুব বেশি বাড়াতে পারবে না।
আপাতত ডিসেম্বর পর্যন্ত দিনে চার লাখ ব্যারেল করে উৎপাদন বাড়ানোর কথা জানিয়েছে ওপেক। এই পরিমাণ বিশ্ব বাজারে তেলের চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। ফলে বিশ্ব বাজারে এখনই তেলের দাম দ্রুত কমার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে ওপেক জানিয়েছে, তারা বর্তমান পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছে। তারা এখনই তেল উৎপাদন বাড়াতে চায় না।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। গত বুধবার (৩ নভেম্বর) রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। নতুন দাম ভোক্তা পর্যায়ে ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছে, যা ওইদিন রাত ১২টা থেকে কার্যকর হয়।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব পড়ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষক থেকে শুরু করে নাগরিক মধ্যবিত্তরা ভোগান্তির শিকার হবেন বেশি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়বে ফলে মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়বে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়বে বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানের ভাড়ায়। লঞ্চসহ নৌযানের ভাড়াও বাড়বে। আর এর পরোক্ষ প্রভাব পড়বে অনেক খাতে। তেল এবং ডিজেলের দাম বাড়লে খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও সরবরাহের খরচ বেড়ে যাবে। ফলে ভোক্তা পর্যন্ত পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত এর দাম হবে কয়েকগুণ।
সূত্র: সিএনবিসি, অ্যাজিউম টেক
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ