ঘুম! ছোট্ট শব্দ বটে কিন্তু তার প্রয়োজনীয়তা ও প্রভাব সুদূরপ্রসারী। সারাদিনের পরিশ্রমের পর ক্লান্তি দূর করার অব্যর্থ দাওয়াই হল ঘুম। অনেক সময় এই ঘুম আপনার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। অনেক সাধ্য সাধনা করেও দুই চোখের পাতা এক হতে চায়না। আর ডাক্তারি পরিভাষায় একেই বলে অনিদ্রা রোগ বা ইনসমনিয়া (Insomnia)। কখনও এটি এক সপ্তাহ ধরে হয় যখন ঘুম আসে না বা ঘুম আসার পর সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এটা হল অ্যাকিউট ইনসমনিয়া আর যখন প্রায় তিন মাস ধরে এই অবস্থা চলে তখন সেটা ক্রনিক ইনসমনিয়ায় দাঁড়িয়ে যায়।
কেন এমনটা হয় এই প্রশ্ন করলে বলতে পারি যে ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা রোগের জন্য মূলত দায়ী হচ্ছে মানসিক চাপ (Home Remedies Of Insomnia)। সেটা ব্যক্তিগত বা কর্মজীবন যে কোনও জায়গা থেকে আসতে পারে। এছাড়াও মানসিক অবসাদ, অস্থিরতা, শুতে যাওয়ার আগে অতিরিক্ত চা বা কফি পান করা, টিভি বা মোবাইল দেখার অভ্যেস থেকেও এই রোগ হতে পারে। এছাড়াও স্লিপ অ্যাপনিয়া যাঁদের আছে অর্থাৎ ঘুমনোর সময় নিঃশ্বাসের কষ্ট এবং ঘুমের ঘোরে অজান্তে পা নাড়ানো ও থাইরয়েড থেকেও ইনসমনিয়া হতে পারে।
এক আধদিন ঘুম নাই আসতে পারে। অনেক সময় বেড়াতে যাওয়ার পর হোটেলে থাকলে গেলে বা কোনও কারণে নিজের ঘর পরিবর্তন করলে এমনটা হয়। অনেকে আছেন যারা কড়া আলোয় বা সামান্য শব্দ হলেও ঘুমোতে পারেন না, সেটাও অস্বাভাবিক নয়। তবে এটা দিনের পর দিন বা সপ্তাহভর চললে চিন্তার কারণ। তাই সময় থাকতে সাবধান থাকতে হবে এবং দেখতে হবে অনিদ্রা রোগের কোনও লক্ষণ আপনার মধ্যে দেখা যাচ্ছে কিনা। যদি দেখা যায় তাহলে দেরি না করে অবিলম্বে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করুন। তার আগে দেখে নেওয়া যাক ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা রোগের লক্ষণ (Insomnia Symptoms) গুলো কী কী।
হ্যাঁ, আপাত দৃষ্টিতে খুব সহজ বিষয় ম্নে হলেও দীর্ঘ সময় ধরে রাতে ঘুম না আসা হল ইনসমনিয়া রোগের প্রথম ধাপ। আপনি খেয়াল করে দেখবেন এই সমস্যা আপনার প্রতি রাতেই হচ্ছে কিনা। অনেক চেষ্টা করেও যখন ঘুম আসে না তখন বুঝতে হবে যে আপনি অনিদ্রা রোগের শিকার হয়েছেন।
ইনসমনিয়ার দ্বিতীয় লক্ষণ (Insomnia Symptoms) হল ঘুম এলেও সেটা দীর্ঘস্থায়ী না হওয়া। ধরে নেওয়া যাক, অনেক চেষ্টা করে কষ্ট করে আপনার চোখে ঘুম এল। কিন্তু দেখা গেল যে একটু পরেই সেটা ভেঙে যাচ্ছে। আর একবার ভেঙে গেলে আর ঘুম আসছে না। অনেকের ক্ষেত্রে এটা বারবার হয়। অর্থাৎ তাঁরা যতবার ঘুমনোর চেষ্টা করেন ততবার ঘুম ভেঙে যায়।
আপনি হয়তো বলবেন যে অনেকেরই খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস আছে। তাহলে এটা অনিদ্রার লক্ষণ (Insomnia Symptoms) কীভাবে হল? একদম ঠিক। কিন্তু আপনি হয়তো এমনিতে রোজ সাতটায় উঠতেন বা আটটায় উঠতেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে দেখছেন যে আপনার ঘুম ভোর তিনটে বা চারটের সময় ভেঙে যাচ্ছে। এটা কিন্তু আস্তে আস্তে ইনসমনিয়ায় টার্ন নেবে।
অনেকেই মনে করেন যে অনিদ্রা রোগ বা ইনসমনিয়া মানেই হল রাতের পর জেগে থাকা (Symptoms of Insomnia)। বিষয়টি কিন্তু ঠিক তা নয়। অনেক সময় দেখা যায় রাত্রে ঘুমনোর পরেও সকালবেলা আপনার ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে বা বেশ ক্লান্ত লাগছে। ধরে নিতে হবে যে রাত্রে আপনার ঘুম গভীর হয়নি। এটা রোজ হলে বুঝে নিন যে ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত আপনি।
দেখা গেছে যে প্রথম প্রথম যখন ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা রোগের প্রকোপ শুরু হয় তখন একজন ব্যক্তি প্রায় গোটা দিন ভীষণ ক্লান্ত বোধ করেন। তাঁকে দেখে মনে হয় যে তিনি এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বেন। তিনি নিজেও ঘুম-ঘুম ভাব অনুভূত করেন। এর মূল কারণ হচ্ছে তিনি এখন ইনসমনিয়ার প্রথম ধাপে আছেন।
রাতের পর রাত যদি আপনার ঘুম না হয় তাহলে মানসিক অস্থিরতা, অবসাদ বা অ্যাংজাইটি দেখা দেওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাছাড়া আপনি যদি সত্যিই চিকিৎসকের কাছে গিয়ে জানতে পারেন যে আপনি অ্যাকিউট বা ক্রনিক ইনসমনিয়ার রোগী হয়ে গেছেন, সেটাও মনের উপর খুব চাপ সৃষ্টি করে।
দেখা গেছে ৫০% ইনসমনিয়ার রোগী কাজে হঠাৎ করে অমনোযোগী হয়ে ওঠেন। এঁরা এর আগে কেউই কোনও কাজ দেরি করে করা বা পরে করব বলে রেখে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন যে কর্মক্ষেত্রে বা বাড়ির কাজে অমনোযোগী হয়ে উঠলে খতিয়ে দেখতে হবে যে এঁদের রাত্রে ভাল করে ঘুম হচ্ছে কিনা (Symptoms of Insomnia) বা এঁরা আদৌ রাত্রে ঘুমচ্ছেন কিনা।
আগের লক্ষণটির সঙ্গে এটি বিশেষভাবে জড়িত। রাতের পর রাত জেগে থাকার কারণে মনের উপর অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি হয়। অনেকেই এই চাপ নিতে পারেন না। যে কাজ এতদিন তাঁরা ফোকাস নিয়ে করে এসেছেন সেই কাজে তাঁরা মন বসাতে পারেন না। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেয় ছোট ছোট জিনিস ভুলে যাওয়ার প্রবণতা। কোন জিনিসটা কোথায় রেখেছেন বা রান্নায় নুন দিয়েছেন কিনা এসব তাঁরা মনে রাখতে পারেন না।
কাজে মনোযোগ চলে যাওয়ার দরুণ এঁদের কাজে অনেক ত্রুটি দেখা দেয়। যে কাজ এতদিন তাঁরা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছেন সেই কাজে প্রচুর ভুল চোখে পড়ে। রাতের পর রাত ঘুম না আসায় এঁদের স্নায়ু খুব অস্থির থাকে (Symptoms of Insomnia)। আর সেইজন্য রাস্তা পার হওয়ার সময় বা ছুরি দিয়ে সব্জি কাটতে গিয়ে এঁরা ছোটখাট দুর্ঘটনার কবলে পড়ে যান।
যারা বুঝতে পারেন বা যাঁদের চিকিৎসক জানিয়ে দেন যে তাঁদের ইনসমনিয়া হয়েছে তাঁরা ঘুম না আসা নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত চিন্তা করতে থাকেন। এতে লাভের লাভ কিছু হয়না উল্টে ঘুম আসার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে আসে। ইনসমনিয়া শুরু হওয়ার গোড়ার দিকে আরও বেশি করে হয়। ঘুম না হওয়া শুরু হলে খামোখা চিন্তা না করে ডাক্তারের কাছে চলে যান। সেটাই বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে।
অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া ধরা পড়লে ভয় পেয়ে যাওয়ার কিছু নেই। বেশিরভাগ মানুষেরই শর্ট টার্ম ইনসমনিয়া হয় যেটা পরে সেরেও যায়। তাই ভয় না পেয়ে কয়েকটি সহজ ঘরোয়া উপায় (Natural Treatment of Insomnia) ট্রাই করে দেখতে পারেন। আমাদের জীবনযাত্রার জন্যও অনেক সময় ঘুম না আসার সমস্যা হয়, সেগুলো একটু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও ইনসমনিয়া সেরে যায়।
ধ্যান বা মেডিটেশন করা মানে হল ডিপ ব্রিদিং করা। এটা নিয়ম করলে আপনার স্নায়ু, শরীর এবং মন তিনটেই নিয়ন্ত্রণে থাকবে। দেখবেন নিয়মিত ধ্যান করলে রাত্রে ঘুমনোর সমস্যা অনেকটাই কমে গেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হল ধ্যান করলে স্ট্রেস কমে। স্ট্রেস ইনসমনিয়ার একটি কারণ সেটা ভুলে গেলে চলবে না।
২০১১ সালে এই গবেষণাটি করা হয়েছে। এটিও মেডিটেশন বা ধ্যানের একটি অংশ বলা যেতে পারে। একই মন্ত্রের বার বার উচ্চারণ করলেও মন ও শরীর নিয়ন্ত্রণে আসে। এই মন্ত্র পজিটিভ হতে হবে। বাংলা, হিন্দি, ইংরিজি বা সংস্কৃত যে কোনও ভাষায় এই মন্ত্র আপনি খুঁজে নিতে পারেন। একা একা শুনুন বা জোরে চালিয়ে শুনুন, কাজে দেবে।
কোনও রকম ওষুধের প্রয়োগ ছাড়াই যদি রাত্রে আরাম করে ঘুমোতে চান এবং ইনসমনিয়া থেকে মুক্তি (Natural Treatment of Insomnia) চান তাহলে যোগব্যায়াম বা যোগার কোনও বিকল্প নেই। কয়েকটি যোগা আছে যা রাত্রে খাওয়ার পর অভ্যেস করলে ঘুমোতে কোনও অসুবিধে হয়না।
দেখা গেছে যারা সারাদিন কোনও শারীরিক পরিশ্রম করেন না, তাঁদের রাত্রে ঘুম আসতে অসুবিধে হয়। কারণ তাঁদের কোনও এনার্জি ক্ষয় হয়না। তাই নিয়ম করে প্রতিদিন হাল্কা এক্সারসাইজ করুন। এর মানে এই নয় যে আপানাকে জিমে যেতে হবে। আপনি সকালে আধ ঘণ্টা হাঁটুন, স্কিপিং করুন। এতে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি হবে এবং আপনার রাত্রে ঘুম ভাল হবে।
সব সময় যে ইনসমনিয়া বা অনিদ্রার কারণে ঘুম আসে না তা কিন্তু নয়। শরীরে কোনও অস্বস্তি থাকলেও চট করে ঘুম আসতে চায়না। তাই মাঝে মধ্যে একটু আধটু মাসাজ (Natural Treatment of Insomnia) করলে রাত্রে ঘুম ভাল হবে। পেশাদার কাউকে দিয়ে মাসাজ নাও করাতে পারেন। নিজের পা বা মাথা একটু নিজেই মাসাজ করে নিতে পারেন।
ম্যাগনেসিয়াম হল এমন একটি খনিজ যা পেশীকে শিথিল করতে এবং স্ট্রেস কম করতে সাহায্য করে। তাই যে সব খাবারে ম্যাগনেসিয়াম আছে সেগুলো খাওয়া শুরু করুন। ডার্ক চকোলেট, বাদাম, অ্যাভোকাডো এগুলতে ম্যাগনেসিয়াম আছে। রাত্রে এগুলো খেলে ভাল উপকার পাবেন।
ল্যাভেন্ডার অয়েল ব্যথা কমায়, ভাল ঘুম নিয়ে আসে ও আপনার মুড উন্নত করে। এটি অ্যান্টি ডিপ্রেশনের ওষুধ হিসেবেও কাজ করে। তাই শোয়ার আগে বালিশে এই অয়েল ছড়িয়ে দিন (অনিদ্রা দূর করার ঘরোয়া উপায়)। একটু আলাদা করে শুঁকে নিন বা এই তেল স্নানের জলে মিশিয়ে স্নান করুন।
মেলাটোনিন হল এমন একটু বস্তু যা ভাল ঘুম নিয়ে আসতে সাহায্য করে। শুধু ঘুম আসতে নয়, ঘুম যাতে দীর্ঘস্থায়ী আর ঘন হয় সেটাও করে এই মেলাটোনিন। টম্যাটো, বেদানা, শসা, ব্রোকোলি, সর্ষে, আখরোট ইত্যাদিতে মেলাটোনিন থাকে। এগুলো প্রতিদিনের ডায়েটে যোগ করুন (Natural Treatment of Insomnia), দেখবেন ঘুমের সমস্যা অনেকটাই কমে গেছে। সূর্যের আলোতেও কিন্তু মেলাটোনিন থাকে তাই সূর্যের আলোও গায়ে লাগাবেন।
বিশেষ কোনও দিন ছাড়া বাকি সময়টা ঘুমের একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিন (অনিদ্রা দূর করার ঘরোয়া উপায়)। শরীরকে সেই সময়ের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে দিন। আজ ন’টার সময়, কাল এগারোটার সময় এভাবে একেক দিন একেক সময়ে শুতে যাবেন না। নির্দিষ্ট সময় ঘুমনোর অভ্যেস করলে ঘুম না আসার সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আসবে।
ঘুমের সঙ্গে কিন্তু মানসিক শান্তির একটা যোগ আছে। যেখানে আপনি ঘুমচ্ছেন, সেই ঘর যদি নোংরা হয় বা অগোছালো হয় তাহলে ঘুম না আসাটা স্বাভাবিক। তাই বেডরুম সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখুন। এতে কিন্তু যথেষ্ট কাজ দেবে।
আমাদের লাইফস্টাইলের সঙ্গে কিন্তু ঘুম না আসার গভীর সম্পর্ক আছে। তাছাড়া গর্ভাবস্থায় অনেক ওষুধ মহিলাদের খেতে হয়। তাই সেই সময় তাঁরা অনেকেই অনিদ্রায় ভোগেন। এমনকী মেনোপজ হওয়ার কিছুদিন আগে এবং পরেও অনিদ্রা হয়। সেইজন্য আপনাদের কিছু গাইডলাইন (Home Remedies Of Insomnia) দিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে আপনারা সেগুলো অনুযায়ী চলতে পারেন।
উত্তর: যে সব খাবারে হাই প্রোটিন আছে বা সুগার আছে, সেই জাতীয় খাবার খেলে রাত্রে ঘুম আসতে অসুবিধে হয়। মিষ্টি খাবার, হাই প্রোটিন খাবার রাত্রে না খাওয়াই ভাল।
উত্তর: হ্যাঁ, কারণ কলায় আছে ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়াম যা পেশীকে শিথিল করে দেয়। তাছাড়া এতে কার্বোহাইড্রেট থাকে যা এমনিতেই মানুষকে আচ্ছন্ন করে দেয়।
উত্তর: খুব কম বা বলা চলে এক লাখে এক জনের এমন হতে পারে। তবে তার আগে অনেকগুলো স্তর আছে। অনিদ্রা হলেই যে মৃত্যু হবে তা নয়। অনিদ্রা হলে ওজন কমে যায়, প্যানিক অ্যাটাক হয়, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায় তারপর মৃত্যু হতে পারে।
উত্তর: হিসেবমতো আমাদের ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। কিন্তু যাঁদের অনিদ্রা রোগ আছে তাঁরা দুই থেকে তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমোন না।
উত্তর: মূলত পাঁচ প্রকারের অনিদ্রা রোগ আছে। অ্যাকিউট ইনসমনিয়া অর্থাৎ অল্প কিছু দিনের জন্য ঘুম না আসা। ক্রনিক ইনসমনিয়া অর্থাৎ দীর্ঘকালীন অনিদ্রা, কমরবিড ইনসমনিয়া বা অন্যান্য শারীরিক ত্রুটির সঙ্গে অনিদ্রা, অনসেট ইনসমনিয়া অর্থাৎ ঘুম আসতে দেরি হওয়া এবং মেনটেনেন্স ইনসমনিয়া বা ঘুম ভেঙে যাওয়ার সমস্যা।
বাংলা৭১নিনউজ/সূত্র: সংগৃহিত