মৌলভীবাজারের বড়লেখার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন হাকালুকি হাওরের মালাম বিলের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের খাসজমি থেকে হিজল-করচ-বরুণসহ নানা প্রজাতির প্রায় ২০ হাজার জলজ গাছ কাটার ঘটনায় মামলা হয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালায় মামলা করা হয়।
গতকাল মঙ্গলবার (২২ জুন) রাত ১১টার দিকে বড়লেখা থানায় পরিবেশ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে ৭ জনের নাম উল্লেখ করে মামলাটি করেন।
মামলার আসামিরা হচ্ছেন মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার বর্ণি ইউনিয়নের মনাদি গ্রামের সুফিয়ান আহমদের ছেলে জয়নাল উদ্দিন, কাজীরবন্দের গ্রামের মৃত আকদ্দছ আলীর ছেলে মক্তদির আলী, মৃত আমরুজ আলীর ছেলে মশাঈদ আলী, মৃত মইয়ব আলীর ছেলে রিয়াজ আলী, ছত্তার আলীর ছেলে জয়নাল উদ্দিন, আব্দুল হান্নানের ছেলে কালা মিয়া ও মৃত মইয়ব আলীর ছেলে সুরুজ আলী। মামলায় ১৫ থেকে ২০ জন অজ্ঞাতনামা আসামি রাখা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, হাকালুকি জাগরণী ইসিএ ব্যবস্থাপনা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদস্য ও মালাম বিল বনায়ন এলাকার পাহারাদার আবদুল মনাফ গত রবিবার পরিবেশ অধিদপ্তরে একটি অভিযোগ দেন। তাতে বলা হয়েছে, হাকালুকি হাওরের মালাম বিলের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের খাসজমির প্রায় ১২ বিঘা জমিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের সৃজিত বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ এবং প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছ কর্তন করা হয়েছে।
মালাম বিলের বাঁধ ও চাষের জমি তৈরির জন্য প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (২১ জুন) মামলার বাদী অভিযোগকারী, হাল্লা ফরেস্ট বিটের বিট কর্মকর্তা সুমন বিশ্বাস এবং হাকালুকি ইসিএ ব্যবস্থাপনা বহুমুখী সমবায় সমিতির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে মালাম বিলের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের খাসজমির প্রায় ১২ বিঘা জমিতে সৃজিত বিভিন্ন প্রজাতির জলজ বৃক্ষ হিজল, করচসহ অন্যান্য প্রজাতি এবং প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ১০ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার আনুমানিক ১৫ থেকে ২০ হাজার গাছ কর্তন করেছেন। তারা মালাম বিলের বাঁধ নির্মাণ ও জমি চাষের জন্য উপযোগী করার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ধারা ৫-এর উপধারা ১ ও ৪ এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে হাকালুকি হাওরের ১৮ হাজার ৩৮৩ হেক্টর এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া-ইসিএ) ঘোষণা এবং সুস্পষ্ট বিধিনিষেধ আরোপ করে। ইসিএ এলাকার প্রতিবেশব্যবস্থা সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য সরকার কর্তৃক ইতিমধ্যে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১৬ জারি করা হয়েছে।
ইসিএ এলাকা হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য মৎসা ও জলজ প্রাণী এবং পাখির বসবাসের উপযোগী রাখার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর হাকালুকি হাওরে বনায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করে। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা অনুযায়ী বিদ্যমান প্রাকৃতিক অবস্থা এবং জীববৈচিত্র্য, বন্য প্রাণীর আবাসস্থলসহ সংরক্ষিত বন ও রক্ষিত এলাকা, নদ-নদী, খাল-বিল, প্লাবনভূমি, হাওর-বাঁওড়, লেক, জলাভূমি, পাখির আবাসস্থল, মৎস্য অভয়াশ্রমসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জলজ অভয়াশ্রম, জলাভূমির বন, ম্যানগ্রোভ ও উপকূলীয় এলাকার অবক্ষয় সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এজাহারে আরো বলা হয়েছে, আসামিরা প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় আরোপিত বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে পরিবেশ অধিদপ্তরের সৃজিত ও প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা জলজ বৃক্ষ কর্তনের মাধ্যমে হাকালুকি হাওরের মৎস্যসম্পদ, জলজ প্রাণী, পাখির আবাসস্থল, উদ্ভিদের জলজ অভয়াশ্রমের ক্ষতিসাধন করেছেন। এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর ধারা ৫-এর উপধারা ৪ এবং প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০১৬-এর বিধান লঙ্ঘন করেছেন, যা দণ্ডনীয় অপরাধ।
পরিবেশ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা বলেন, জলজ বৃক্ষ কাটার ঘটনায় ৭ জনের নাম উল্লেখ করে বড়লেখা থানায় মামলা করা হয়েছে। মামলায় ১৫ থেকে ২০ জন অজ্ঞাতনামা আসামি রাখা হয়েছে। মামলার তদন্তে আর কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাদের চার্জশিটে অন্ত্মর্ভুক্ত করা হবে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালায় মামলা করা হয়েছে।
বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার মামলার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
হাকালুকি হাওরে গাছ কর্তনকারীদের শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ দাবি, হাকালুকি হাওরের মালাম বিলে হিজল-করচসহ বিভিন্ন প্রজাতির ২০ হাজার বৃক্ষ নিধন ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি শীর্ষক এক অনলাইন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার (৯ জুন) পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা’র উদ্যোগে এই আলোচনা সভার আয়োজন হয়।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে ও পবা’র সম্পাদক প্রাণ-প্রতিবেশ বিষয়ক গভেষক পাভেল পার্থ সঞ্চালনায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন, পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সোবহান, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক (মৌলভীবাজার) লেখক ও সাংবাদিক আকমল হোসেন নিপু, বিশিষ্ট কবি ও লেখক পরিবেশকর্মী শাহেদ কায়েস, দৈনিক ইত্তেফাকের বড়লেখা উপজেলা সংবাদদাতা তপন কুমার দাস, দৈনিক দেশ রূপান্তরের মৌলভীবাজার প্রতিনিধি রিপন দে, পবার সম্পাদক ও গ্রিনফোর্স সমন্বয়ক মেসবাহ সুমন, বানিপার সভাপতি প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।
সভায় বক্তারা পাঁচ দফা সুপারিশে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে দোষিদের আইন ও বিচারের আওতায় আনা, ইসিএ হিসেবে ঘোষিত হাকালুকি হাওরের বৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় সকল ইজারা বাতিল করা, হাওরের জলাভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনায় হাওরবাসী জনগোষ্ঠীকে যুক্ত করা এবং জনগোষ্ঠীভিত্তিক সংরক্ষণ উদ্যোগ নেওয়া,
হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া, ইকোসিস্টেম বজায় রাখার জন্য হাওরের পানি, উদ্ভিদ, ধান, ভাসমান এবং ক্ষুদ্র অনুজীবদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, যেখানে গাছ কাঁটা হয়েছে সেখানে আবার নতুন করে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করা এবং গাছ লাগানোর পর প্রতিটি গাছের রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ