বাংলা৭১নিউজ,ডেস্ক: বাংলাদেশ ও ভারতের দুই শীর্ষ নেতা ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ যে আলোচনার সূত্রপাত করেন, ১৮ মার্চ শনিবার পূর্ণ মতৈক্যের মধ্যদিয়ে তা সমাপ্ত হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ বলেন, ‘দুই প্রধানমন্ত্রী শীতলক্ষ্যা নদীতে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা নৌবিহারের পুরো সময় আলোচনা করেছেন। ১৯ মার্চ ঢাকা ও দিল্লি থেকে প্রকাশিত ঘোষণায় দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সমঝোতার কথা ঘোষিত হবে।’
১৮ মার্চ ব্যস্ততম দিন কাটিয়েছেন সফররত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এদিন বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার ও পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে বিশেষ জনমত গড়ে তোলা হচ্ছে। ইন্দিরা গান্ধী নিহত ও অপহৃত বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালে তাদের অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।’
লাল ফিতা নিয়ে বাড়াবাড়ি নয়
লাল ফিতা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত কার্যকর করার পরামর্শ দিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রী তাদের লক্ষ্য ও নীতি কর্মকর্তাদের কাছে ব্যক্ত করেন। দুই দেশের দুই নেতা ও বিশেষজ্ঞরা যৌথ বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ব্যাপক অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে আলোচনা করেন। এসব আলোচনা মনোরম পরিবেশে হয়েছে। দুই দেশ বন্যা নিয়ন্ত্রণের যৌথ প্রচেষ্টা, সীমান্ত বাণিজ্য, চোরাচালান প্রতিরোধ, পণ্য চলাচল এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বন্দি বিনিময় মতৈক্যে পৌঁছেছেন বলে জানানো হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ বলেন, ‘আলোচনায় তিনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়েছেন।’
দু’দেশের সরকারের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে ভারতীয় মুখপাত্র তার একটি বিবরণ দেন। এসব আলোচিত বিষয়ের মধ্যে রয়েছে— বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বন্যানিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের সহযোগিতা। দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় এসব বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পূর্ণ মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় মুখপাত্র বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এখন যে সীমারেখা তা শান্তির, অতি উত্তেজনা ও সংঘাত সৃষ্টির সীমান্ত নয়।
ইন্দিরা গান্ধীর আবেগ
শীতলক্ষ্যা নদীতে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা ধরে দুপাশের সবুজ জনপদ দেখে জলপথে নৌবিহারের পরপরই ইনভেস্টিগেটর ভিজিটরস বুকে তার ব্যক্তিগত অনুভূতি লিপিবদ্ধ করেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি লেখেন, ‘এই সুশীতল মৃদুমন্দ সমীরণ রূপসী বাংলার পল্লী দৃশ্য মুছে দেবে অতীতের সেইসব শোষণ আর সীমাহীন অত্যাচারের ভয়াবহ দিনগুলোর স্মৃতি। আপনাদের মহান নেতার নেতৃত্বে এক সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যতের যাত্রাপথে বাংলাদেশের অভিযান সফল হোক।’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিশেষ জনমত গড়ে তোলা হচ্ছে। তিনি নিহত বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশে বক্তৃতা করছিলেন। বাসস এ খবর প্রকাশ করে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের অবশ্যই ফিরিয়ে আনা হবে, কিন্তু এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তারা এমন এক দেশে আটক আছেন, যে দেশ ঘরে ঘরে আমাদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে।’ এর আগে তিনি বলেন, ‘এ সম্পর্কীয় মানবিক দিকটা নিয়ে মস্কোতে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।’
খোলা গাড়িতে ঢাকার রাস্তায়
শ্রীমতি গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে খোলা গাড়িতে করে বঙ্গভবনে ফিরছিলেন। সেসময় রাস্তার দুপাশে হাজার হাজার জনতা গগনবিদারী স্লোগান দিয়ে তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছিল।
ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার প্রশংসা করেন। বঙ্গভবনে ঘরোয়া পরিবেশে গান্ধী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক স্বাধীনতা সংগ্রামে বুদ্ধিজীবীরা এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে গান্ধী বলেন, ‘তিনি সাফল্যের ব্যাপারে পরোয়া করেন না।’ তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি কী, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার যেটা ন্যায় মনে হয় সেটাই করি।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সাহিত্যের উন্নতি ও বিকাশ সাধনে বাংলাদেশে প্রচুর সম্ভাবনা আছে।’
শুভেচ্ছা বাণী নিয়ে এসেছি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশি সংকল্পবদ্ধ মানুষ বাংলাদেশকে এক সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ রূপে গড়ে তুলবেন। বাংলাদেশের মানুষের জন্য শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কোনও বাণী আছে কিনা, জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম জনগণের জন্য ভারতের জনগণের কাছ থেকে আমি শুভেচ্ছা নিয়ে এসেছি।’ উভয় দেশের জনগণের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে উভয় দেশের জনগণের অভিন্ন আদর্শ দৃঢ়-সংকল্প কাজ করে।’
বাংলা৭১নিউজ/জেড এইচ