দেশে গ্যাসের সংকট কমছেই না। বরং আরও তীব্র হচ্ছে। দেশজ গ্যাসের প্রমাণিত মজুত কমতে থাকায় গত দেড় যুগ ধরেই চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ঘাটতি বাড়তে থাকে।
বর্তমানে গড়ে দৈনিক ঘাটতি ১৩০ কোটি ঘনফুটে পৌঁছেছে। সংকট দূর করতে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি শুরু হলেও এখন পর্যন্ত সক্ষমতার শতভাগ ব্যবহার করা যায়নি।
বিশ্ববাজারে এলএনজির মূল্য বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় আমদানির পরিমাণও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে গ্যাস-সংকটে দেশের শিল্প উৎপাদন কমে যাচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সিএনজিচালিত যানবাহনের চলাচল কমে গেছে। হ্রাস পেয়েছে কৃষির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সার উৎপাদনও। গ্যাস-সংকটে ভুগছে বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে শিল্প উৎপাদন বাড়ছে। এজন্য যে পরিমাণ গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চয়তা থাকা দরকার তা নেই। বিদ্যমান দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রয়োজনীয় জ্বালানি না পেয়ে হতাশা-ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। একপর্যায়ে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে এলএনজি আমদানি শুরু করে সরকার। কিন্তু দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহের সক্ষমতা থাকলেও তা কখনো ৭৫-৮০ কোটি ঘনফুটের বেশি যায়নি।
বর্তমানে তা ৬০-৬৫ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। আবার আরও এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গতি নেই। সমুদ্রভাগের পুরোটা এবং স্থলভাগের বেশ কিছু স্থানে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও অনুসন্ধান ও খনন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে না। এ পরিস্থিতি বেশ বড় আশঙ্কা তৈরি করছে।
গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, স্পিনিং, উইভিং ও ডাইং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং মিলের অধিকাংশই নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রে (ক্যাপটিভ পাওয়ার) উৎপাদনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যেখানে মূল জ্বালানি গ্যাস। গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। ফলে যেসব টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে তাদের উৎপাদন কার্যত বন্ধ রয়েছে।
তিনি জানান, বিটিএমএর কিছু সদস্য মিলে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে তথা ১ দশমিক ৫০ পিএসআইতে (প্রতি বর্গ ইঞ্চি) নেমে গেছে। ফলে মিলগুলোতে স্থাপিত মেশিনারিজের সক্ষমতার ৭০ শতাংশ অব্যবহৃত থাকছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ বাড়িয়ে পরিস্থিতির উন্নতি করা যেতে পারে। নইলে বর্তমান পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ও ব্যাংক ঋণের নিয়মিত কিস্তি পরিশোধসহ ইউটিলিটি বিল ও অন্যান্য খরচ মেটানো কঠিন হবে।
সাভারের একটি গার্মেন্টস মালিক জানান, কোভিডের ক্ষতি কাটিয়ে উঠে এখন বিদেশ থেকে অনেক অর্ডার আসছে। নতুন বিনিয়োগ পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। কিন্তু জ্বালানি না থাকলে উত্পাদন হবে কী করে। এতে অনেক শিল্পমালিকের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে বিদ্যুতের মূল্য আগের মতো সস্তা নেই। বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য সহনশীল রাখতে হবে। তবে তার আগে প্রয়োজন, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহের নিশ্চয়তা। এটি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। তিনি বলেন, দেশে বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি আগের চেয়ে খারাপ।
আমাদের এফডিআইয়ের আকার-প্রবৃদ্ধি সাধারণ মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য নয়। চীন, ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনামে এফডিআই বেড়েছে। অথচ বাংলাদেশে এটি কমেছে। আমাদের বাণিজ্যিক ও নীতিগত আচরণ-চর্চার কারণে বিদেশি বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে আসছে না। নানা অনিয়ম ও অসহযোগিতার কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনীহা রয়েছে। এ পরিস্থিতি এবং আচরণ-চর্চার উন্নতি না হলে বিদেশি বিনিয়োগেও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হবে না।
বাংলাদেশ তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) তথ্য অনুযায়ী, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪২০-৪৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। গত ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর সরবরাহ করা হয়েছে প্রায় দৈনিক ২৯৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস। অর্থাৎ ঘাটতি ১৩০ থেকে ১৩৪ কোটি ঘনফুটে পৌঁছেছে। দেশের ইতিহাসে সাম্প্রতিক সময়ে এটিই সবচেয়ে বেশি পরিমাণের ঘাটতি।
বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২২৫ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে পাচ্ছে ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। সার কারখানাগুলো ৩১ কোটি ঘনফুটের স্থানে পাচ্ছে ১৩ কোটি ঘনফুট। শিল্প, সিএনজি, বাণিজ্য, চা-বাগান এবং আবাসিক খাত ১৬৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাচ্ছে। এখানে আরও অন্তত ১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। পরিস্থিতি সামাল দিতে গত রবিবার থেকে দৈনিক চার ঘণ্টা সিএনজি ফুয়েলিং স্টেশন বন্ধ রাখা শুরু হয়েছে। তবে এতে টেকসই সমাধান আসবে না বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পেট্রোবাংলার এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে ১৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস-সংকট এক-দেড় বছরের মধ্যেই মেটানো সম্ভব। বিদ্যমান দুই টার্মিনাল পুরোদমে চললে এবং দৈনিক ৫০ কোটি গ্যাস সরবরাহ ক্ষমতার স্থলভিত্তিক দুইটি এলএনজি টার্মিনালের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তা দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করলে গ্রিডে প্রতিদিন আরও ১৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে। প্রতি বছর প্রায় ১০ শতাংশ হারে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে দেশজ গ্যাস আবিষ্কার করে পাইপলাইনে আনা এবং এলএনজি আমদানির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, পেট্রোবাংলা এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে গ্যাসের বার্ষিক চাহিদা ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা যাচ্ছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪৩ দশমিক ২৮ শতাংশ, শিল্পকারখানায় ১৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ, বাসাবাড়িতে ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ, শিল্পকারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র (ক্যাপটিভ পাওয়ার) ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ, সার উত্পাদনে ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ, সিএনজি স্টেশনে ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ, বাণিজ্যিকে দশমিক ৭৬ শতাংশ ও চা-বাগানে দশমিক ১০ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার হয়।
বর্তমানে গ্যাসের অভাবে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতৎ উৎপাদন করতে পারছে না কেন্দ্রগুলো। কয়লা, ডিজেল ও ফার্নেস তেলের চেয়ে গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন সাশ্রয়ী হলেও সরবরাহ না থাকায় তেলে উৎপাদন বাড়িয়েছে পিডিবি। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আঞ্চলিক ভারসাম্যও রক্ষা করতে হয়। তা না হলে সাব-স্টেশন পর্যায়ে কিছুটা সমস্যা হয় এবং এর ফলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে।
এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে গ্যাসের মজুত বাড়াতে সম্ভাব্য সবই করা হচ্ছে। বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বাড়ায় খোলা বাজার থেকে আমদানি স্থগিত করা হয়েছিল। তবে আবারও আমদানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। চলতি মাসেই তিন কার্গো এলএনজি কেনা হবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী এর অনুমোদন দিয়েছেন।
তিনি জানান, গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত খোলাবাজার বা স্পট মার্কেট থেকে মোট ১৩ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হয়। এরপর স্পট মার্কেট থেকে আমদানি বন্ধ করা হয় মূল্য বৃদ্ধির কারণে। গত বছর প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ছিল ৩ দশমিক ৮৩ ডলার। বর্তমানে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম প্রায় ২০ ডলার।
গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্প্রতি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, গ্যাসের চাহিদার চেয়ে সরবরাহ এখন কম রয়েছে। পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় অনেকগুলো শিল্পে নতুন সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না। ঘাটতি দূর করতে এলএনজি আমদানি আরো বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশীয় উৎস থেকেও সংগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এলএনজির দাম বাড়লেও শিল্পে এর চাহিদা রয়েছে। খরচ বেশি পড়লেও ব্যবসায়ীরা এখন গ্যাস চান। সেই সক্ষমতা তাদের রয়েছে। সরকার সে অনুযায়ী জোগান দেওয়ার চেষ্টা করছে।
জ্বালানি বিভাগের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশজ গ্যাসের উত্পাদন ২৪০-২৫০ কোটি ঘনফুট থাকলেও চলতি বছরেই গ্যাসের দৈনিক উত্পাদন ২৩০ কোটি ঘনফুটে নেমে আসতে পারে। বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত না হলে ২০২২-২৩ সালে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে দিনে উৎপাদন ১৮ দশমিক ৪ কোটি ঘনফুট কমতে পারে। ২৩-২৪ সালে দৈনিক উৎপাদন ৪৩ দশমিক ৫ কোটি ঘনফুট কমে যেতে পারে।
এ সময় সবচেয়ে বেশি গ্যাস উত্পাদনকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠান শেভরনের অধিকাংশ গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন বন্ধ হতে পারে। বিকল্প হিসেবে সরকার এলএনজির আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দৈনিক ২০০ থেকে ২৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস এলএনজি আমদানি করে মেটানো হবে বলে আশা করছে সরকার। ২০৪১ নাগাদ শুধু বিদ্যুকেন্দ্রের জন্যই দৈনিক ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন হবে।
জ্বালানি খাতের কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, এমন অবস্থায় স্থলভাগে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সময়ক্ষেপণ করছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। চাপ প্রয়োগ করছে একাধিক দেশি কোম্পানিও।
দেশের সমুদ্রভাগে বিপুল পরিমাণ গ্যাস-খনিজ পাওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট ও অপচয় করা হচ্ছে। ভোলা-নোয়াখালী-বরিশাল-খুলনা-রাজশাহীর স্থলভাগেও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তা খুঁজে পেতেও অনুসন্ধান কার্যক্রম নেই। দেশীয় উত্স এবং আমদানির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু দুই প্রান্তেই পিছিয়ে রয়েছে সরকারি উদ্যোগ-কার্যক্রম।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ