জন্মের পরপরই পুরো বিশ্বের মনোযোগ কাড়ে ছোট্ট মেয়ে লক্ষ্মী। কারণ চার হাত ও চার পা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে সে। অনেকেই তাকে দেবী ভেবে দূর-দূরান্ত থেকে দেখতে আসতে শুরু করে। কেউ বলেছিলেন লক্ষ্মী আশির্বাদ; আবার কারও মতে অভিশাপের ফল!
ভারতের বিহারের এক গ্রামে ২০০৫ সালে জন্মগ্রহণ করে লক্ষ্মী তত্মা। ইস্কিওপ্যাগাস সংযুক্ত যমজ যুগলের মধ্যে একজন সে। তার মাথা ছিল একটিই, তবে তার শরীরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল অপুষ্ট জমজ ভাইয়ের শরীরের একাংশ। চিকিৎসকরাও এমন অস্বাভাবিক শিশুকে দেখে রীতিমতো চমকে গিয়েছিলেন।
হাঁটা তো দূরের কথা, বসতে পর্যন্তও পারত না মেয়েটি। তার এমন করুন অবস্থা দেখে চিকিৎসকরা সার্জারি করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ প্রথম অবস্থাতেই তার সার্জারি করা না হলে, পরবর্তীতে হয়তো সে সুযোগও থাকবে না।
তবে লক্ষ্মী অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। তার বাবা একজন দিন মজুর। মেয়ের সার্জারি করার মতো অর্থ তার পক্ষে জোগাড় করা ছিল অসম্ভব বিষয়। তবে চিকিৎসকরাও ছেড়ে দেয়নি এতো বড় একটি বিষয়কে।
তারা চিকিৎসাবিদ্যার সব রকম সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে ধাপে ধাপে সার্জারি করেন ছোট্ট লক্ষ্মীর শরীরে। লক্ষ্মীর শরীরের সঙ্গে তার জমজের হাত-পাগুলো সংযুক্ত থাকলেও মাথা ছিল না। তবে কিডনিসহ শরীরে ভেতরের বিভিন্ন অঙ্গ দু’টো করে ছিলো।
চিকিৎসকরা বলেছিলেন, এ অবস্থায় থাকলে লক্ষ্মীকে ২ বছরও বাঁচানো যাবে না। কারণ শারীরিক বিভিন্ন সমস্যায় জন্মের পর থেকেই ভুগছিলো সে। তার মধ্যে আলসার সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছিলো লক্ষ্মীকে।
লক্ষ্মীর নতুন জীবনের সূচনা হলো যেভাবে
ভারতের নামকরা সার্জন শরণ পাতিল লক্ষ্মীর জীবনে আসেন আশির্বাদ রূপে। লক্ষ্মীর যখন ২ বছর বয়স; তখনই তার সার্জারির সব বন্দোবস্ত করা শুরু হয়। ২০০৭ সালে সবশেষ প্রস্তুতির পরে লক্ষ্মীর শরীরে প্রথম অস্ত্রোপচার চালানো হয়।
চিকিত্সকরা লক্ষ্মীর শরীর থেকে অতিরিক্ত হাত-পা অপসারণ করতে সক্ষম হন। এই অপারেশনটি বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন অস্ত্রোপচারের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এর আনুমানিক ব্যয় ধরা হয় ২০০ হাজার ডলার। টানা ২৭ ঘণ্টা ধরে অপারেশন করা হয় লক্ষ্মীর।
৩০ জন সার্জন অত্যাধিক সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্মীর অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেন। অস্ত্রোপচারের পরও চিকিৎসকদের নজরেই ছিলো লক্ষ্মী। কারণ তখনও ছোট ছোট কিছু সার্জারি করা বাকি ছিল। সবগুলো অস্ত্রোপচার শেষে সে সুস্থ হয়ে উঠলো লক্ষ্মী।
অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হওয়ার ২ বছরের মাথায় ৪ বছর বয়সী লক্ষ্মী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হাঁটতে শেখে। সমবয়সীদের মতো সব কাজগুলোই একা করা শিখে নেয় সে। যদিও লক্ষ্মী স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারে না। কারণ তার মেরুদণ্ডে কিছুটা বক্রতা আছে। তবে সে নিজে চলাফেরা করতে পারে।
এরপর শুরু হয় লক্ষ্মীর নতুন জীবন। প্রতিবন্ধী শিশুদের বিশেষ প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা শুরু করে লক্ষ্মী। বর্তমানে লক্ষ্মীর বয়স ১৬ বছর। ভবিষ্যতে সে স্নাতক সম্পন্ন করে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
লক্ষ্মী এবং তার পরিবার আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ও চিকিৎসকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। যাদের প্রয়াসে লক্ষ্মী আবারও নতুন জীবন পেয়েছেন তাদের প্রতি লক্ষ্মীর পুরো পরিবার কৃতজ্ঞতা জানান।
এক সাক্ষাৎকারে লক্ষ্মীর মা বলেন, অস্বাভাবিক জন্ম নেওয়ার কারণে নানা মানুষ মন্তব্য করেছে। একবার তো লক্ষ্মীকে সার্কাসে বিক্রি করার জন্য প্রস্তাব পেয়েছিলাম। আমরা যতই গরীব হই না কেন, সন্তানকে বিক্রি করতে চাইনি।’
এ ছাড়াও জন্মের পরপরই প্রতিবেশীরা লক্ষ্মীর পরিবারকে একঘরে করে রেখেছিলেন। নানা অপবাদ আর কুৎসা রটনা করছিলেন। আবার অনেকেই শিশুটিকে দেবতার পার্থিব প্রতিমূর্তি হিসাবে বিবেচনা করতে শুরু করেছিল। তবে আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে লক্ষ্মী এখন স্বাভাবিকভাবেই জীবনযাপন করছে।
সূত্র: বিবিসি/লিটল থিংস
বাংলা৭১নিউজ/এবি