বাংলা৭১নিউজ, ঢাকা: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীসহ ওই এলাকার ‘নিষ্ক্রিয়’ কর্মকর্তাদের আগামী তিন দিনের মধ্যে অব্যাহতির সময় বেঁধে দিয়ে ঢাকার শাহবাগ থেকে অবরোধ তুলে নিয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা।
আজ বেলা পৌনে ১২টা থেকে সন্ধ্যা পৌনে ৭টা পর্যন্ত তাদের এই অবরোধের কারণে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এই মোড় হয়ে যান চলাচল বন্ধ থাকে, আশপাশের সড়কে সৃষ্টি হয় যানজট।
বিক্ষোভ চলাকালে মন্ত্রী ছায়েদুল হকের কুশপুতুল পোড়ানো হয়। বিক্ষোভকারীদের হাতে প্ল্যাকার্ডে লেখা দেখা যায়- ‘হিন্দু হয়ে জন্মানোই কি আমাদের অপরাধ’, ‘দেশত্যাগই কি আমাদের একমাত্র পথ?’, ‘হিন্দুজাতির অপমান মানি না, মানব না, নাসিরনগরে হামলা কেন জবাব চাই’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সচেতন হিন্দু শিক্ষার্থীবৃন্দ’, ‘সাধারণ হিন্দু শিক্ষার্থীবৃন্দ’, ‘সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ’, ‘রমনা কালি মন্দির ও আনন্দমীয় আশ্রম পরিচালনা পরিষদ’সহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের ব্যানারে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী এই বিক্ষোভে অংশ নেন।
আন্দোলনরতদের ‘সমন্বয়ক’ মানিক রক্ষিত সন্ধ্যায় অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে বলেন মন্ত্রীসহ অন্য ‘নিষ্ক্রিয় কর্মকর্তাদের’ আগামী তিন দিনের মধ্যে অব্যাহতি দিতে হবে।
তা না হলে ১৫ নভেম্বর সকাল ১০টায় আবার শাহবাগে সড়ক অবরোধ করার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব সংগঠনকে ওই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
অবরোধ শুরুর সাত ঘণ্টা পর বিক্ষোভকারীরা সরে গেলে ওই সড়কে আবার যান চলাচল শুরু হয় বলে শাহবাগ থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক জানান।
ফেইসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে গত ৩০ অক্টোবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ১৫টি মন্দির ভাঙা হয়; ভাংচুর-লুটপাট করা হয় হিন্দুদের শতাধিক ঘর-বাড়ি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ওসির উপস্থিতিতে সমাবেশে ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্যের পর ওই হামলার ঘটনা ঘটায় স্থানীয় প্রশাসনের গাফিলতির অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। এর পাঁচদিনের মাথায় একই এলাকায় কয়েকটি বাড়ি ও মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়।
ওইদিনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রায় এক ঘণ্টা শাহবাগে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই হামলার নেপথ্যে ছিল নাসিরনগরের এমপি ছায়েদুল হকের সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর দ্বন্দ্ব। মোকতাদিরের সমর্থকরা যে প্রতিপক্ষকে বেকায়দায় ফেলতে হিন্দুদের বাড়ি-মন্দিরে হামলায় ইন্ধন যুগিয়েছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কথাতেই তা স্পষ্ট। নাসিরনগর ছাড়াও গত দুই সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েক ডজন মন্দিরে হামলা ও প্রতীমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘছে, যার প্রতিবাদে আজ সকাল সাড়ে ১০টায় জগন্নাথ হলের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীরা।
মিছিলটি টিএসসি-দোয়েল চত্বর হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে যায়। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান নেওয়া বেশ কয়েকটি সংগঠনের কর্মীরা তাদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং সবাই মিছিল করে শাহাবাগে আসেন।
এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে সকাল থেকে জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিল কয়েকটি সংগঠন। প্রেসক্লাব থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মিছিল শাহবাগে এসে অবস্থান নিলে ওই সংগঠনগুলোর কর্মীরাও অবরোধে যোগ দেয়।
অবরোধ চলাকালে আন্দোলনের সমন্বয়ক মানিক রক্ষিত মন্ত্রী ছায়েদুল হককে অপসারণের দাবি তুলে ধরে বলেন, “মন্ত্রী ও এমপি পদে থাকার নৈতিক অধিকার তিনি হারিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিন। প্রধানমন্ত্রী যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের এই দাবি মেনে না নেবেন, ততক্ষণ অবরোধ চলবে।”
সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, হামলাকারীদের বিচার না হওয়ায় মৌলবাদী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ফের হামলা করার সাহস পাচ্ছে।
“মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সনাতন ধর্মের মানুষদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে গড়ার কথা বলেছিলেন আজও তা হয়নি। এখনও সনাতন ধর্মের মানুষের উপর নির্যাতন চলছে, এটা দুঃখজনক।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক প্রিয়াংকা বোস কান্তা সমাবেশে বলেন, “বলা হচ্ছে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। এই অবরোধ কি তাই প্রমাণ করে?
“অসাম্প্রদায়িক দেশে কোনো সাম্প্রদায়িক বৈষম্য কিংবা এলিমেন্ট থাকতে পারে না। সরকার যদি অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে থাকে- তা প্রমাণ করে দেখাক।”
বিক্ষোভ-সমাবেশ থেকে ছায়েদুল হকের অপসারণ ও তার ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ’ ছয় দফা দাবি জানানো হয়।
নাসিরনগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলায় শিকার সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ও ধর্মীয় উপসানালয় আবার নির্মাণের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া, ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া, হামলার উসকানিদাতা, মদদদাতা এবং হামলাকারীদের বিচারের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করার দাবি রয়েছে এর মধ্যে।
নাসিরনগরে হামলার ঘটনার পর থেকে ছয়টি হিন্দু পরিবারের খোঁজ মিলছে না অভিযোগ করে শিক্ষার্থীরা বলেন, বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়ে দেশান্তরী হয়েছে এমন পরিবারগুলোকে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে, একটি সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীন সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করতে হবে।
শাহবাগ মোড় দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় ছুটির দিনেও প্রেসক্লাব থেকে মৎস্যভবন হয়ে রূপসী বাংলার মোড়, কাঁটাবন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতরে যানজট তৈরি হয়।
অনেক বাস নির্ধারিত রুটে যেতে না পেরে রূপসী বাংলা মোড়, কাকরাইল মসজিদ, কাঁটাবন, নীলক্ষেত মোড় হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে গস্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে।
শাহবাগ থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বিকালে বলেন, “আমরা শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করছি। এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে, সাধারণ জনগণের ভোগান্তি হচ্ছে, তারা যেন উঠে যায়।”
এরপর সন্ধ্যায় টানা অবরোধের কর্মসূচি থেকে সরে আসেন বিক্ষোভকারীরা। সরকারকে তিন দিন সময় দিয়ে তারা অবরোধ তুলে নেন। এর আগে শাহবাগে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয়।
বাংলা৭১নিউজ/এন