১৩ বছর আগে ১১ হাজার টাকা বেতনে সেকশন অফিসার হিসেবে চাকরি শুরু করেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) সহকারী রেজিস্ট্রার নজরুল ইসলাম হীরা। চাকরিজীবনে বেতন-ভাতা মিলিয়ে অর্ধকোটি টাকা উপার্জন না করলেও নামে -বেনামে গড়েছেন কয়েক কোটি টাকার সম্পদ।
চাকরির শুরুতে একটি টিনশেডের ঘর থাকলেও সেখানে এখন পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের বহুতল ভবন। আর এতকিছু করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বহিষ্কৃত সহকারী একান্ত সচিব গাজী হাফিজুর রহমান লিকুর ক্ষমতার অপব্যবহার করে।
লিকু গাজীর ডান হাত নজরুল ইসলাম হীরা কর্মস্থলে গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির সিন্ডিকেট। ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে ৪৯টি কম্পিউটার চুরির মাস্টারমাইন্ড হিসেবে অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে দিয়েছেন হুমকি, করেছেন প্রতিবাদ মিছিল।
বর্তমানে বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক দলের ক্রীড়া সম্পাদক শওকত আলী দিদার হত্যা মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি হয়ে পলাতক নজরুল ইসলাম হীরা। গত তিন মাস অফিস না করেও নিচ্ছেন বেতন ভাতা। নিয়মানুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আর দুর্নীতি দমন কমিশন বলছে, এটি দুদক আইনের ২৭ এর ১ ধারায় অবৈধ সম্পদ অর্জনের অপরাধ। অভিযোগ আমলে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নজরুল ইসলাম হীরার বাবা পেশায় ছিলেন একজন দিনমজুর। গোপালগঞ্জ শহরের মিয়াপাড়া এলাকায় টিনশেডের একটি বাড়ি ছিল তাদের। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। ২০০৮-০৯ সালে সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের ভিপি নির্বাচিত হন।
এরপর গাজী হাফিজুর রহমান লিকুর ক্ষমতায় যোগ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার হিসেবে। সেসময়ে তার বেসিক বেতন ছিল ১১ হাজার টাকা। পরে একই সূত্রের ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে বাগিয়েছেন পদোন্নতি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-রেজিস্ট্রার পদে কর্মরত নজরুল ইসলাম। বেতন পাচ্ছেন ৪৩ হাজার টাকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্র বলছে, গত ১৩ বছরের চাকরিজীবনে নজরুল ইসলাম বেতন-ভাতা মিলিয়ে ৩৫ লাখের মতো টাকা আয় করেছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে টেন্ডার হাতিয়ে নেওয়া, নিয়োগ ও ভর্তি বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, কমিশন বাণিজ্য করে গড়েছেন কয়েক কোটি টাকার সম্পদ। গোপালগঞ্জশহ বিভিন্ন জায়গায় গড়ে তুলেছেন কয়েক কোটি টাকার সম্পদ।
গোপালগঞ্জ শহরের মিয়াপাড়া এলাকায় রয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দুটি বহুতল ভবন। যার একটিতে তিনি বসবাস করেন। শহরের বেদগ্রাম এলাকার রঘুনাথপুর রোডের পাশে রয়েছে ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ৮ শতাংশ জমি।
মাদারীপুরের শিবচরে হাউজিং প্রকল্পে ৬ কাঠা ও ৩ কাঠার প্লট ১৭ লাখ টাকায় বরাদ্দ নিয়েছেন। নিজে ব্যবহারের জন্য ২০১৫ সালে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে কিনেছেন গাড়ি। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে কোটি টাকার এফডিআর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘নজরুল ইসলামের পেছনে ছিল লেকু গাজীর হাত। তিনি সেই প্রভাবে চলতেন। ২০১৯ সালে তৎকালীন ভিসির আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌষ্য কোটার নিয়ম ছিল। তিনি কামাল ইবনে পাশা নামের একজনকে এফিডেভিড করে ভাগনে পরিচয় দিয়ে কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে ভর্তি করেন।
বিভিন্ন সময়ে টেন্ডার হাতিয়ে নিজেদের নামে নিয়েছেন। ফার্নিচার ক্রয়ের টেন্ডার নিয়ে নিম্নমানের ফার্নিচার কিনে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার চুরির ঘটনায়ও তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছিল। যদিও তদন্ত কমিটিকে লেকু গাজীর মাধ্যমে প্রভাবিত করে নিজেকে নির্দোষ সাজিয়েছেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘হীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গাজী হাফিজুর রহমান লিকুর প্রভাবে যা ইচ্ছা তাই করছেন। অবৈধভাবে গণভবন থেকে তদবির করিয়ে নিজের পদোন্নতি নিয়ে সহ-রেজিস্ট্রার পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। গোপালগঞ্জ ও আশপাশের এলাকার অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে করেছেন নিয়োগ বাণিজ্য। তিনি হাফিজুর রহমান লিকুর কাছের লোক হওয়ায় অনেক কিছু করতে পারতেন।
রাফি নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, “নজরুল ইসলাম আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ মিছিল করেছেন। শিক্ষার্থীদের হুমকি দিয়েছেন। তিনি ক্যাম্পাসে এলে তার সঙ্গে সব হিসাব মিলিয়ে নেওয়া হবে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মোরাদ হোসেন বলেন, ‘বর্তমান তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত। ছুটির আবেদন করেছিলেন। তবে সেটি ভিসি স্যার এখনো গ্রহণ করেননি। বর্তমান তিনি তার বেতন-ভাতা নিয়মিত পাচ্ছেন।’
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. হোসেন উদ্দিন শেখর বলেন, ওই কর্মকর্তার ছুটির আবেদন এখনো গ্রহণ করা হয়নি। তাকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
জেলা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক মশিউর রহমান বলেন, সরকারি চাকরি করে অন্য পেশায় থাকার সুযোগ নেই। তবে নিজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তিনি করতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, ওই কর্মকর্তা যদি চাকরিজীবনে আয়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সম্পদের মালিক হন, তাহলে দুদক আইনের ২৭ এর ১ ধারায় অবৈধ সম্পদ অর্জনের অপরাধ। অভিযোগ আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মির মো. সাজেদুর রহমান বলেন, নজরুল ইসলাম বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক দলের ক্রীড়া সম্পাদক শওকত আলী দিদার হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। তাকে গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার নজরুল ইসলাম হীরা। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ হলেও আমি ছিলাম অ্যান্টি আওয়ামীলী। সব নেতারা একপাশে আর আমি একপাশে থেকে লেকু গাজীর রাজনীতি করে গেছি। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আসছে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের অন্য একটি গ্রুপ এগুলো করাচ্ছে।’
নজরুল ইসলাম আরও বলেন, মাদারীপুরে তিন কাঠার একটি প্লট রয়েছে। তবে বেদগ্রাম কোনো জমি কেনা নেই। চাকরির শুরুতে বেতন স্কেল ১১ হাজার হলেও আমি ভাতা পেতাম।
তিনি বলেন, চাকরির শুরুতে টিনশেডের ঘর ছিল। পরে আমরা উপার্জন করে বাড়িটি বানিয়েছি। ওই জমিটি আমার মায়ের। আমার সম্পর্কে না জেনে কিছু বলা যাবে না। আমি অফিস থেকে কত টাকা লোন নিয়েছি তথ্য নিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে।
অফিস না করে বেতন নিচ্ছেন কীভাবে জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ছুটির আবেদন করেছি। মায়ের অসুস্থতা আর মিথ্যা মামলার কারণে অফিস করা হচ্ছে না। কিছুদিনের মধ্যেই অফিস শুরু করবো।’
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ