ছ’মাস হয়ে গেল ব্যারিস্টার রফিক উল হক নেই। তাতে অবশ্য কিছু থেমে নেই। তবে, মনে হলে আমার মতো কেউ কেউ বোধ হয় কিছুটা সময়ের জন্য থেমে যান। করোনাকাল বলেই হয়তো এতো বড় মানুষের প্রয়াণেও তেমন কোনো স্মরণ সভা চোখে পড়েনি। তাঁকে নিয়ে ভাবলে কেমন অসহায় লাগে। কতো কথা, কতো স্মৃতি তাঁর সাথে আমার। কিন্তু, লিখতে বসলেই ভেতরটা হুঁ-হুঁ করে উঠে। চারপাশ ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। নিজেকে অভিভাবকহারা মনে হয়। সম্প্রতি আব্বাকে হারিয়ে কষ্টটা আরও বেড়ে গেছে। তাদের কথা ভাবলে শুধু কান্না আসে।
এক-এগারোর অস্থির সময়ে তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। সে সময় রাজনীতি বন্ধ থাকায়, রাজনৈতিক বিটের রিপোর্টার হয়েও খবরের ক্ষুধায় আদালতে নিয়মিত হই। প্রায় প্রতিদিন সংবাদ সংগ্রহে সুপ্রিম কোর্টে যাই। এবং বেশিরভাগ দিনই তাঁর সাক্ষাৎকার নেই। দেশের প্রধান দুই নেত্রীর প্রধান আইনজীবী তিনি। আদালতে তাঁর সাহসী, ক্ষুরধার ও মানবিক যুক্তি-তর্কের ভক্ত হয়ে যাই। সবার সঙ্গে সাক্ষাৎকার নিলেও একা একা আবার তাঁর চেম্বারে যেতাম। আইনি শব্দকে মুখের ভাষায় এনে তাকে জিজ্ঞাসা করতাম, ভুল হবে কি? তিনি খুশি হয়ে বলেন, ঠিক আছে। এভাবে বললে, সবাই বুঝবে। আর এই ব্যাপারটিকে খুব উৎসাহ দেন সে সময়ে চ্যানেল ওয়ানের প্রধান বার্তা সম্পাদক নাজমুল আশরাফ। তারই নির্দেশে সে সময় ব্যারিস্টার রফিককে নিয়ে টক’শো করি। উদ্দীন’স সরকার, বঙ্গবন্ধু, শহীদ জিয়া, দুই নেত্রী নিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হওয়ায় দুই পর্বে প্রচার হয় সেটি।
অন-এয়ারের সময় আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালের তহবিল সংগ্রহে দেশের বাইরে ছিলেন ব্যারিস্টার হক। ইতিমধ্যে শোরগোল পড়ে যায় ওপাড়ায়। তারা অফিসে এসে টক’শোর সিডি নিয়ে যায়, আমাকে খোঁজে। আমার হয়ে আশরাফ ভাই দুই দিন হাজিরা দেন। উড়ো ফোনে আদালতের বিভিন্ন কোণা-কাঞ্চিতে দেখা করতে বলে সাদা পোশাকে থাকা তারকা-খচিত পদাধিকারীরা। আমি সতর্ক হয়ে চলি এবং বলি।
দু’সপ্তাহ পর দেশে ফেরেন রফিক উল হক। সুপ্রিম কোর্টের দোতলায় গ্যাংওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুমে ডাকেন। হাসতে হাসতে বলেন, ভয় পেয়েছো? দেখি, সব খবর জানেন তিনি। আমি বললাম, জাতির অভিভাবক আমার সঙ্গে থাকলে কিসের ভয়? বাসায় রেকর্ড করে রাখা টক’শোটি দেখেছেন উল্লেখ করে বলেন, তুমি আমাকে অনেক খুঁচিয়েছ। তারপর মাথা দুলিয়ে মজা করে বলেন, আমিও কিন্তু বেশ জবাব দিয়েছি।
সময়-অসময়ে ফোন করতেন। আমাকে ভেবে অন্যদেরও ফোন দিয়েছেন বহুবার। তারা আবার ফোন দিয়ে আামাকে বলেছে, স্যার আপনাকে খুঁজছে। তাঁর পল্টনের বাসায়, চন্দ্রার বাগানবাড়ি, রেস্তোরাঁয় অনেকের মতো আমাকেও বহুবার আদর করে খাইয়েছেন। হঠাৎ ফোন করে বলতেন, যশোর থেকে কৈ মাছ এসেছে। কোন বেলা আসবে? গেলেই দেশের খবর জানতে চাইতেন। বলার সময় লক্ষ্য করেছি, প্রায় সব কিছুই জানেন তিনি। তাঁর জানার আগ্রহ ছিল অপরিসীম। দু’হাতে আয় করতেন, চার হাত-পায়ে দান করতেন। অথচ, নিজের বাসার বাজার সম্পর্কে বলতেন, লিল্লাহ বোর্ড চালায়। অর্থাৎ, ভক্তরা অমুক জায়গার চাল-তমুক জায়গার মাছ-ফুল-ফল-মিষ্টি নিয়মিত পাঠাতো।
ঢাকায় থাকা কাজিনদের নিয়ে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পারিবারিক বনভোজন করে আসছি। একবার চন্দ্রা মোড়ের কাছে “সোহাগ পল্লী”তে ভেন্যু ঠিক হয়েছে। শুনে বলেন, ওই দিন আমিও তো চন্দ্রা থাকবো। আমাকে দাওয়াত দিবা না? সাথে সাথে দাওয়াত দিলাম। কিন্তু, ভেতরে ভেতরে বিব্রত হই। কেননা, পরিবারের বাইরের কাউকে কখনো নেয়া হয়না। তবে, জানার পর বড় ভাই-বোনেরা খুশি হন। উনি লাঞ্চের সময় সাত-আট জন জুনিয়র নিয়ে হাজির হন। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের পরিবারের সবার সাথে মিশে যান। এর-ওর গলায়-কাঁধে হাত দিয়ে গল্প করেন। বাচ্চাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়ার সময় গাল টিপে দেন। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আমাদের পরিবারের ঐক্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। নিজেও এরকম পরিবেশে বড় হয়েছেন বলে তৃপ্তির কথা জানান। ফেলে আসা শৈশব-কৈশোর, জন্মভূমি, স্বজনদের কথা মনে করে আমাদের সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হন।
বিভিন্ন সময় ব্যারিস্টার রফিক নামের মহাত্মা মানুষটিকে আমার “বিরাট শিশু” মনে হতো। ছোট ছোট প্রাপ্তিতে বিরাট খুশি হতেন তিনি। মামলায় জিতলে খুশি, হারলে শিশুর মতো জেদি হয়ে লেখাপড়া বাড়িয়ে দিতেন। মোটামুটি ভালো ফি নিতেন তিনি। তবে, পুরোটাই বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করতেন। আইনজীবীদের মধ্যে এক নম্বর করদাতা ছিলেন। রাজনীতি সচেতন হলেও কোনো দলের তল্পিবাহক ছিলেন না। যে কারণে মনে হয়, কোনো দলই তাকে নিজের মনে করেনা। কতো অপরিচিত মানুষ রাষ্ট্রীয় পদক পান। অথচ স্বাস্থ্যসেবা, সুশাসন ও গণতন্ত্রের লড়াইয়ে প্রথম সারির এই যোদ্ধার নাম অগোচরেই থেকে যায়। একমাত্র ছেলে, ছেলের স্ত্রী, আদরের নাতনী তাঁর মৃত্যুর ছ’মাস পেরিয়ে গেলেও কানাডা থেকে আসতে পারেনি। আসলে কে কার, তা একমাত্র ভালো জানেন মহান নিরাকার।
সংগৃহীত: ডিআরইউ’র সাবেক সভাপতি ও এসএ টিভির বার্তা সম্পাদক ইলিয়াস হোসেন এর ফেইসবুক পেজ থেকে।