স্বাধীন এবং বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্য সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ। মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) দুপুরে খুলনা বিভাগের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।
কামাল আহমেদ বলেন, মফস্বলে যখন নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে রিপোর্টার হিসেবে তখন আপনাকে শুধু সাংবাদিক নিয়োগ দেওয়া হয়? আপনাকে বিজ্ঞাপন সংগ্রাহক হিসেবেও দায়িত্ব দেওয়া হয়। একইসঙ্গে সার্কুলেশনেরও দায়িত্ব দেওয়া হয়।
একইসঙ্গে সাংবাদিক, বিজ্ঞাপন সংগ্রাহক এবং সার্কুলেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু কোনোটার জন্য আপনাকে বেতন দিচ্ছে না। একটি কার্ড দিলেই হয়। এ রকম অন্যায় হচ্ছে এবং ব্যাপকভাবেই হচ্ছে।
তিনি বলেন, হাতে গোনা কয়েকটি টেলিভিশন-কাগজ, তারা নিয়মিত বেতন দেন। কিন্তু সেই বেতনভাতায় হয়তো বৈষম্য আছে। ওয়েজবোর্ডের যে সুযোগ-সুবিধা ঢাকার বাহিরের সাংবাদিকরা কার্যত পান না। একেবারে কেউ পান না তা বলবো না। যারা পান তারা খুব ব্যতিক্রম ও সৌভাগ্যবান।
ওয়েজ বোর্ডের লাভটা শুধু মালিকরাই পান, তাদের বিজ্ঞাপন রেটটা বাড়িয়ে দিতে পারেন। মাঠের সাংবাদিকরা কখনো সুফল পান না। প্রস্তাব এসেছে, এমন একটা ব্যবস্থা করা দরকার যাতে ন্যূনতম বেতন কাঠামো কার্যকর হয়। সবাই যাতে ন্যূনতম বেতনভাতা পায়। এই প্রস্তাবটা কম গুরুত্বপূর্ণ না। এ প্রস্তাবের নিশ্চয় ভালো দিক আছে।
কামাল আহমেদ বলেন, সারাদেশে সাংবাদিকদের জন্য বেতনের একটা ন্যূনতম হিসাব থাকা দরকার। কারণ সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা যদি না থাকে তাহলে তার স্বাধীনভাবে কাজ করার মানসিকতাও থাকবে না। সাধারণত সে অনেক ক্ষেত্রেই আপস করতে বাধ্য হবে, আপস করবে। ওই যে বিজ্ঞাপন সংগ্রাহকের কাজ করলে যেমন আপস করা হয়।
একটা প্রতিষ্ঠান থেকে বিজ্ঞাপন আনলে তার বিরুদ্ধে লেখা সম্ভব হয় না, ভালো কিছু লিখবেন, কিন্তু বিরুদ্ধে না। তাহলে তো বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা হলো না। স্বাধীন এবং বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্যে সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা দরকার।
একই সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠানেরও আর্থিক সচ্ছলতা দরকার। তার প্রতিষ্ঠানকেও টেকসই করতে হবে। সেই প্রতিষ্ঠানকে টেকসই করার জন্যে সেই প্রতিষ্ঠান যাতে অন্যায়ের শিকার না হয়, অবিচারের শিকার না হয় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, অনিয়ম দূর করলে মূল ধারার প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হবে। ১২ বছর ধরে যে পত্রিকা বন্ধ রাখা হয়েছে বা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়নি সেই প্রতিষ্ঠানতো ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে তাকে দেওয়া হয়নি। এটিতো অন্যায়। এই রাজনৈতিক হয়রানি ও অন্যায় দূর করতে হবে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি যদি সবাই সঠিকভাবে অনুসরণ করে এবং সাংবাদিকতা যদি যথাযথভাবে করা হয় তাহলে যারা টিকতে পারবে প্রতিযোগিতায় তারাই গ্লোবালযোগ্য হবে। টিকতে পারবে তারাই যারা সৎ সাংবাদিকতা করবে, সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করবে। আমাদের সেই লক্ষ্যেই সংস্কারের কথা বলতে হবে। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সকলের মতামতের ভিত্তিতে সুপারিশমালা আমরা সরকারের কাছে দেব। আশা করি সেই সুপারিশমালা সরকার বাস্তবায়ন করবে। গণমাধ্যমগুলো যাতে যথাযথভাবে তার ভূমিকা পালনে সক্ষম হয় তার উপযোগী নীতিমালা প্রণয়নে কমিশন সুপারিশ করবে।
সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে আইন ও নীতিমালায় সম্পাদকের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতার বিষয়গুলোসহ অনেক ইতিবাচক বিষয়বস্তু রয়েছে। তবে যারা অতীতে সরকার পরিচালনা করেছেন তারা নিজেরাই নীতিমালা অনুসরণ করেননি। যে কারণে এই সমস্যাগুলো হয়েছে। তারা তোষণকারীদের খুশি করার জন্য অনেক ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন।
রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে পত্রিকার সার্কুলেশনের সংখ্যা বিষয়ক ডিএফপির মিডিয়া তালিকা তৈরিতে প্রভাব বিস্তার করা হয়েছে। গণমাধ্যমের মালিক, সম্পাদক, গণমাধ্যমকর্মী আমরা সবাই দুর্নীতি ও নিয়মভাঙ্গার অন্যায়ের অংশীদার। সেই কারণেই আজকে এ রকম একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
কামাল আহমেদ আরও বলেন, বিগত ১৫ বছরে অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে অন্যায়ভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এর ফলে যারা চাকুরিচ্যুত হয়ে বেকারত্বের শিকার হয়েছিলেন তারা ক্ষতিপূরণের দাবিদার হওয়ার যোগ্য। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত প্রত্যাহার করা প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা জানান, গণমাধ্যমগুলোয় কর্মরত রাজধানীকেন্দ্রিক সাংবাদিক ও মফস্বল এলাকার সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। সবার জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ দরকার। দলীয় প্রভাব বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গণমাধ্যম অথবা এর কর্মীদের ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করতে হবে।
মতবিনিময় সভায় গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য আখতার হোসেন খান, জিমি আমির, টিটু দত্ত গুপ্ত, আব্দুল্লাহ আল মামুন, বেগম কামরুন্নেসা হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। মতবিনিময় সভায় খুলনা বিভাগের ১০ জেলার প্রায় ১৫০ জন গণমাধ্যমকর্মী অংশ নেন।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ