বাংলা৭১নিউজ ডেস্ক: পরিবারের অমতেই বিয়েটা করবে হাসান। পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। লজ্জার মাথা খেয়ে রিনির ব্যাপারে যতদিন কথা উঠিয়েছে সবাই স্ব স্ব রাগ-গোস্বা বজ্রপাতের মতো হাসানের মাথার উপর ঝেড়ে দিয়েছে। আহত মৃতপ্রায় মানুষের বিড়ালের মতো মিউ মিউ করা ছাড়া আর কী করার থাকতে পারে। হাসানের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আজ আর থেমে থাকবে না, মরে থাকবে না। দৃঢ পায়ে বাবার সামনে গিয়ে কথা ওঠায়, রিনির কী দোষ?
সাথে সাথেই বলে বয়স্ক বাবা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন। ডায়বেটিকস, হাইপ্রসার, হার্টের সমস্যা এসবে একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়া শেষ বিকালের মানুষটি হঠাৎ করেই যেন যুবক হয়ে যান। চিৎকার করে বলেন, কী দোষ মানে! তোমার কথা মতো আমাদের চলতে হবে নাকি?
-না, তা চলবে কেন। কিন্তু বাবা বিয়েটা তো আমার।
অনেকগুলো দাঁত পড়ে যাওয়াতে বাবার বত্রিশ পাটি দাঁত দেখানো হয় না ঠিক, তবে গাল মুখ বেকিয়ে ভেংচি কেটে বলেন, হেলেন শোন ছেলের কথা, ওনার বিয়ে! সাতাশ বছর পর এখন উনি হয়েছেন। ওনার বিয়ে। এই যে, বাড়ি থেকে নেমে পড়ুন। এরপর যা খুশি সেটা করতে পারেন। হাসান বাবার মুখের উপরই বলে ফেলে, ঠিক আছে নেমে যাব।
-এখনি নাম, গেটআউট। তোর মতো ছেলে আমার দরকার নেই।
হাসান সবদিক ভালো করে দেখে। সাতাশ বছরের পরিচিত বাড়ি, দুই ভাই, একটা বোন, স্নেহময়ী নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকা মা। নাহ, একটা চোখ বলে না হাসানের সিদ্ধান্ত ঠিক। একটা মুখ প্রতিবাদ করে না, শধু গরিব বলে রিনি আর হাসানের ভালোবাসাটা কে কেন জলাঞ্জলি দিতে হবে। বেশ রাত। হাসান বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় হয়তো মা তাকিয়ে ছিল। হাসান আর পিছু তাকায়নি। রাস্তায় অনেক মানুষের আনাগোনা। ঢাকা শহরে সূর্য ওঠা আর ডোবা ছাড়া রাত দিনের খুব একটা ব্যাবধান পাওয়া যায় না। সূর্য উঠলে আলোকিত হয় আর ডুবলে অন্ধকার। রাতের আঁধার দূর করতে প্রয়োজন মতো কৃত্রিম আলোর সাধ্যমত চেষ্টা মানুষের। মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে। একটা পঁচিশ। রিনি কি জেগে আছে? আপন মনে প্রশ্ন করে হাসান। মেয়েটার বাবা নেই। মা একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে।
বাড্ডায় ছোট্ট একটা রুম ভাড়া করে মা-মেয়ের বসবাস। ওরা মুন্সিগঞ্জ থেকে এসেছে। না, এসে উপায় ছিল না। একমাত্র ছোট মেয়ে রিনি যখন বাবা বাবা বলে ডাকতে শিখেছে ঠিক সে সময়টাতেই রিনির বাবা হারিয়ে গেল। চলে গেল ডাক না শোনার দেশে। রিনির নানি বহু চেষ্টা করেও মেয়েকে আর বিয়ে দিতে পারেননি। ওর মায়ের একটাই কথা ছিল, মেয়েটা আমার স্বপ্ন। ও বড় হলে আমার সব দুঃখ মুছে যাবে।
নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন সংসারে নানীর আদরের দুলালী ছিল রিনি। ক্লাস টেনের বছর নানী মারা গেলে আর মুন্সীগঞ্জ থাকা হয়নি। জীবিকার সন্ধানে ঢাকা চলে আসা। অনেক কষ্ট হলেও মেয়েটার লেখাপড়া বন্ধ করেননি। অনার্স ফাস্ট ইয়ারের বছর হাসানের সাথে পরিচয়। বাবার অসুস্থতার কারনে বাড্ডার একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যায় হাসান। চিপ গেস্ট। সবুজ বাংলা নাটকে সবুজ শাড়িতে অভিনয় করেছিল রিনি। এক কথায় অপূর্ব সুন্দর। এক দেখাতেই ভালো লেগে যায়। খোঁজ নিতে অবশ্য দুই দিন লাগেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ুয়া গরিব মায়ের একমাত্র মেয়ে। হাসান ফোন করে, রিনি।
– জ্বি, বলেন।
– জেগে আছো।
– জেগে না থাকলে কথা বলছি কী করে।
-ও হ্যাঁ, তা কী করো?
– তেমন কিছু না।
– ভালো। কিছু করার চেয়ে না করাই ভালো।
-মানে!
– মানে কিছু না।
– আপনি কোথায়?
– রাস্তায়, তোমাদের বাড়ি আসছি।
– কী বলেন! এতো রাতে?
– আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
– আপনার পরিবার সেটা মানবে না।
– আমি সবকিছু ছেড়ে এসেছি।
– না, পাগলামি করবেন না প্লিজ। রিনির কণ্ঠটা ভিন্ন রকম শোনায়।
– মানে?
– আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না। আগে পড়াশোনা শেষ করি।
– সেটা বিয়ের পরেও করা যাবে।
– সরি, হাসান। রিনির শেষ কথাটায় হাসান যেন আকাশ থেকে পড়ে। দশ বিশ তলা উপর থেকে পড়লে কি হয়! হাত-পা গুড়িয়ে যায়। পাজর ভাঙে, স্বপ্ন ভাঙে। একটা কথা হাসানকে অনেকটা সেরকম অবস্থায় ফেলে দেয়। শব্দহীন সব ভাঙাচোরা চলে। কী করেনি মেয়েটার জন্য! সবটুকু উজাড় করে দিয়েছে। চারটা বছর আপন হয়ে পাশে থেকেছে। কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত ওর জন্য বাড়ি ছাড়লো আর সে কি না তাকে প্রত্যাখ্যান করছে! না, সেটা হতে পারে না।
ফোনটা কেটে দিয়ে রিনিদের বাসার দিকে হাঁটে। বিশ মিনিটের হাঁটা পথ। দেখতে দেখতেই চলে আসে। দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে রিনির কণ্ঠ ভেসে আসে।
– কে?
– আমি, হাসান। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দেয়। ঘরে ঢুকতেই প্রথম দেখা সেই রিনির সাথে। যার জন্য বাবা ছেড়েছে,মা ছেড়েছে, ভাই-বোন ছেড়েছে। রিনির পেছনেই দাঁড়ানো সুদর্শন এক যুবক। আগে কোনোদিন দেখা হয়নি। মুন্সীগঞ্জ থেকে আসা কোন আত্মীয় হতে পারে। একটু বাদেই রিনির মা এসে উপস্থিত হন। হাসান কে দেখেই বলেন, কেমন আছো বাবা?
– জ্বি, ভালো।
– তা এতো রাতে, কী মনে করে?
– রিনি কে তো বলেছি, আপনাকে বলেনি?
– হ্যাঁ, বলেছে। তা হঠাৎ এ পাগলামি কেন?
– পাগলামির কী হলো? আমি ওকে ভালোবাসি। দেখার পর থেকে চার বছর ধরে দিনরাত ভালোবাসি।
– ঠিক আছে, তা রিনির তো একটা মতামত আছে।
– সে মতামত হাজার বার জেনেছি। আমার যখন খুশি, যেভাবে খুশি সে আমাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত এটাই তার মতামত।
– ছিল হাসান। কথা বলে রিনি, আপনার জানা থাকার কথা মানুষের চিন্তা-ভাবনা, স্বপ্নের কিন্তু পরিবর্তন হয়।
– কী বলতে চাও তুমি! হাসান অনেকটা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। যুবক ছেলেটা একটু এগিয়ে এসে রিনির সামনে দাঁড়ায়।
– ম্যাডাম আপনাদের ইন্টারনাল আলোচনায় আমার থাকা ঠিক নয়। আমি যাই।
-না না আপনি যাবেন কেন আপনার সাথে আমার কথা শেষ হয়নি। মায়াভরা কণ্ঠে রিনির এ আবেদনে হাসানের বুক চিরে যায়। জানতে খুব ইচ্ছা করে কে এই যুবক। রিনি যেন হাসানের মনের কথা বুঝতে পারে।
-ইনি রওনক। একজন জনপ্রিয় প্রডিউসর। হাসান আপনি জানেন আমি অভিনয় পছন্দ করি। আজই অফার পেলাম একটা…
হাসান থামিয়ে দেয়, বুঝতে পেরেছি। হাসানের চোখ বেয়ে অজান্তেই অশ্রু গড়ায়। খুব হাসতে ইচ্ছে করে। একটানা কতক্ষণ হাসা যায়!
– হাসান আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমার ক্যারিয়ারটা সুন্দর হোক এটা কি আপনি চাইবেন না।
-জ্বি, চাই। আপনারা ভালো থাকুন। রিনি আপনার স্বপ্নগুলো সার্থক হোক। সুবোধ বালকের মতো কথাগুলো বলে। তারপর নীরবেই বেরিয়ে পড়ে। শেষ রাতের রাস্তায় মানুষের আনাগোনা কিছুটা কমেছে। তারপরও ছুটছে মানুষ, চলছে। কেন! সবাই স্বপ্ন পূরণে ব্যস্ত। স্বপ্ন কী! স্বপ্ন কি পূরণ হয়, না ভাঙে? সূর্য উঠলে ঘুমন্ত মানুষ বোঝে রাতের স্বপ্ন মিথ্যা। দিনের আলো ফুটতেই নতুন স্বপ্নের পেছনে ছোটা…এভাবেই স্বপ্নেরা স্বপ্ন ভেঙে চলে। দিন-রাত। হাসান হাঁটে, আজ তার কোনো স্বপ্ন নেই। চোখের পানিতে ধুয়ে যায় বুকের স্বপ্ন।
লেখক: গল্পকার ও উপন্যাসিক
বাংলা৭১নিউজ/সিএইস