বাংলা৭১নিউজ,ডেস্ক: ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর জেনারেল এবং বিপ্লবী গার্ড বাহিনী কুদসের প্রধান কাসেম সোলেইমানি বাগদাদে এক মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হবার পর দেশটির শীর্ষ নিরাপত্তা কাউন্সিল বলেছে, ‘সঠিক সময়ে এবং সঠিক জায়গায়’ এ হত্যার প্রতিশোধ নেয়া হবে।
নিরাপত্তা কাউন্সিলের ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনি।
বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে জেনারেল সোলেইমানি নিহত হবার পর বিশ্বের নেতৃবৃন্দ উদ্বিগ্ন প্রতিক্রিয়া জানান।
ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদুল মাহদী বলেছেন, এ আক্রমণের ফলে মধ্যপ্রাচ্য এবং তার বাইরেও যুদ্ধ বেধে যেতে পারে।
ঠিক এ আশংকারই প্রতিফলন ঘটে জাতিসংঘের মহাসচিব এ্যান্টোনিও গুতেরেসের প্রতিক্রিয়ায়। মি. গুতেরেস বলেন, উপসাগরে আরেকটি যুদ্ধের ঝুঁকি নেবার মত অবস্থা বিশ্বের নেই – এবং তিনি রাষ্ট্রনেতাদের সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ চায় না তবে আমেরিকানদের জীবন বিপন্ন হলে চুপ করে থাকবে না।
তবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনি তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ হামলার চরম প্রতিশোধ নেয়া হবে।
গত রোববার ইরাকে কাতাইব হেজবোল্লাহ নামে মিলিশিয়া বাহিনীর অবস্থানের ওপর বিমান হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র – যাতে ২৫ জন নিহত হয়।
এর আগে একটি সামরিক ঘাঁটির ওপর রকেট হামলায় একজন আমেরিকান ঠিকাদার নিহত হবার পর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবেই ওই হামলা চালায় আমেরিকানরা। এর পর কাতাইব হেজবোল্লাহর ওপর আক্রমণে নিহতদের স্মরণে শোক মিছিলে আগত বিক্ষোভকারীদের হাতে বাগদাদে মার্কিন দূতাবাস আক্রান্ত হয়।
এর কয়েকদিনের মধ্যেই সোলেইমানির ওপর বিমান হামলা চালানো হলো।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, জেনারেল সোলেইমানি মার্কিন কূটনীতিক এবং কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় বলেছেন, জেনারেল সোলেইমানি বহু লোকের মৃত্যুর জন্য দায়ী এবং ‘তাকে অনেক বছর আগেই তুলে নেয়া দরকার ছিল।’
জেনারেল সোলেইমানি ছিলেন ইরানীদের চোখে একজন বীর বা হিরো। তার মৃত্যুতে ইরানে এখন চলছে শোক প্রকাশের পালা।
ইরান ‘প্রতিশোধ’ হিসেবে কী করতে পারে?
ইরানের শীর্ষ নিরাপত্তা কাউন্সিল বলছে, তেহরান ‘সঠিক সময়ে এবং সঠিক জায়গায়’ কাসেম সোলেইমানি হত্যার প্রতিশোধ নেবে।
জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের এক বৈঠকে পর দেয়া এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘কঠোর প্রতিশোধ’ নেবার কথা বলা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়: এই অপরাধীসুলভ দু:সাহস দেখানোর পরিণামের জন্য মার্কিন প্রশাসনই দায়ী হবে।
বলা হয়, “পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে এটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় কৌশলগত ভুল এবং এর পরিণাম তারা এড়াতে পারবে না।”
ইরান বলেছে তারা যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তবে কী কী পদক্ষেপ বিবেচনা করা হচ্ছে তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি।
ইতিমধ্যেই ইরানের ইসলামিক রিভোলিউশনারি গার্ডস কোর বা আইআরজিসির এলিট বাহিনী কুদসের নতুন প্রধান হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসমাইল ক্বানিকে নিয়োগ করেছেন দেশটির শীর্ষ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনি।
জেনারেল ক্বানি এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তার আঞ্চলিক মিত্রদের কড়া নিন্দা করে বক্তব্য দিয়েছেন। ২০১৮ সালে তিনি অভিযোগ করেন মধ্যপ্রাচ্যে গোলযোগ সৃষ্টির ওয়াশিংটনই ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলা বাস্তবায়ন করেছে।
ইরাকের প্রধানমন্ত্রী যেমন আশংকা প্রকাশ করেছেন – এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কি সত্যি যুদ্ধ বেধে যেতে পারে?
ইরান এবং আমেরিকার মধ্যে একটা যুদ্ধ লেগে যেতে পারে, এই সন্দেহ গত বছর খানেক ধরেই চলছিল, কিন্তু সেই সাথে যুদ্ধ এড়ানোর একটা চেষ্টাও তলে তলে চলছিল। ফ্রান্স এই দুই শত্রুর মধ্যে একটা মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছিল।
কিন্তু বিবিসির প্রধান আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা লিজ ডুসেট মনে করছেন, মি. সোলেইমানি এবং ইরাকি শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীর (পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্স) প্রধান আবু মাহদি আল মোহানদিসকে হত্যার পর যুদ্ধ এড়ানোর সেই চেষ্টা ধসে পড়বে সন্দেহ নেই।
বিবিসির বিশ্লেষক জেরেমি বোওয়েন বলছেন, ইরানের হাতে আধুনিক রকেট ও মিসাইল আছে – কিন্তু এসব অস্ত্র যদি তারা মার্কিন বাহিনীর ওপর প্রতিশোধমূলক হামলার জন্য ব্যবহার করে তাহলে পরিস্থিতি বরং খারাপ হতে পারে।
তারা যদি উপসাগরে মার্কিন জাহাজে আক্রমণ চালায় সেটাও প্রচন্ড পাল্টা হামলা ডেকে আনতে পারে।
ইরানের তেল শোধনাগারগুলো পারস্য উপসাগরে উপকুলের পাশেই, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে বিপুল সামরিক ক্ষমতা – তাতে এগুলো খুব সহজ টার্গেটে পরিণত হবে।
ফলে ইরান হয়তো প্রতিশোধ নিতে পারে “সামনের দরজা দিয়ে নয়, বরং পাশের জানালা দিয়ে” – অর্থাৎ ‘পরোক্ষ কৌশলে’ – যা জেনারেল সোলেইমানি নিজে ব্যবহার করতেন – বলছেন জেরেমি বোওয়েন।
বিবিসির বিশ্লেষক জোনাথন মার্কাসও বলছেন, যুদ্ধ সত্যি বাধবে কিনা – এটা একটা বড় প্রশ্ন।
তিনি বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হয়তো মনে করতে পারেন যে একটি নাটকীয় পদক্ষেপ দিয়ে তিনি ইরানকে ভয় পাইয়ে দিতে পারেন। হয়তো তিনি আশা করবেন যে তার মিত্র ইসরায়েল এবং সৌদি আরবও এখন বুঝবে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখনও দাঁত-নখ আছে।
তবে ইরান যে একটা কড়া জবাব দেবে না এটা অচিন্ত্যনীয়। তবে কিছু ঘটলেও তা খুব শিগগিরই নাও ঘটতে পারে – বলছেন মি. মার্কাস।
ইরাকে এখন মোতায়েন আছে ৫ হাজার মার্কিন সৈন্য – যারা হয়তো একটা হামলার সম্ভাব্য লক্ষ্য হতে পারে। ইরান বা তার প্রক্সিরা যে সব লক্ষ্যে অতীতে আঘাত হেনেছে – তাদের কথাও ভাবা হতে পারে।
কিন্তু এটাও খুবই সম্ভব যে ইরানী প্রতিক্রিয়া হয়তো বাঁধা ছকের বাইরে কিছু হতে পারে, হয়তো ইরান নিছক একটা হামলা করার জন্যই হামলা চালাবে না।
হয়তো তারা ওই অঞ্চলে ইরানের যে ব্যাপক সমর্থন আছে তাকে কাজে লাগাতে পারে, এতে সেই সব প্রক্সিদেরও তারা ব্যবহার করতে পারে যাদেরকে এই সোলেইমানিই গড়ে তুলেছেন।
হয়তো তারা বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসটি যেভাবে ঘেরাও করেছিল সেটাই আবার নতুন করে শুরু করতে পারে এবং তা ইরাকের সরকারকে একটা কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিতে পারে।
ইরাকে মোতায়েন করা মার্কিন বাহিনী নিয়েও তখন গুরুতর সব প্রশ্ন উঠতে পারে।
ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের এর মধ্যেই ইরাক ছেড়ে যেতে বলা হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার জানিয়েছে, বিদেশী তেল কোম্পানিতে কাজ করতেন এমন আমেরিকান নাগরিকদের অনেকে শুক্রবারই ইরাক ছেড়ে যাচ্ছেন।
বাংলা৭১নিউজ/সূত্র: বিবিসি অনলাইন