সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার এ যুগ পূর্ণ হলো আজ। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন এই সাংবাদিক দম্পতি। এক যুগ পার হলেও এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
এখন পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১০৫ বার সময় নিয়েছেন বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা। কবে নাগাদ মামলার তদন্ত শেষ হবে বলতে পারছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশের হাত ঘুরে বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব)।
সবশেষ গত ২৩ জানুয়ারি মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু ওই দিনও তদন্ত সংস্থা র্যাব প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারায় ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফি উদ্দিনের আদালত আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী দিন ধার্য করেন। এ নিয়ে একশ পাঁচ বারের মতো পেছানো হয়েছে এ মামলার প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ।
আদালত সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ মামলাটি তদন্ত করেছেন র্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম। মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চেয়ে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে হত্যাকাণ্ডের এত বছর পেরিয়ে গেলেও ছেলে হত্যার বিচার না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাগর সারোয়ারের মা সালেহা মনির। তিনি বলেন, একযুগ পার হতে যাচ্ছে সাগর-রুনির হত্যার। এখন পর্যন্ত আমার ছেলের হত্যাকারী কে সেটাই জানতে পারলাম না। ছেলেকে তো আর ফেরত পাবো না।
আমার একটাই কথা, ছেলে হত্যার বিচার চাই। এখন পর্যন্ত আমার ছেলের কবর জিয়ারত করতে যাইনি। প্রতিজ্ঞা করেছি, যেদিন ছেলের হত্যাকারীদের দেখবো, ওইদিন কবর জিয়ারত করবো। এর আগে যদি আমার মৃত্যু হয়, হোক। খুনিদের না দেখে আমি ছেলের কবর জিয়ারত করতে যাবো না।
তিনি আরও বলেন, র্যাব তো সব জানে। প্রতিবেদন জমা দিলেই তো হয়। প্রতিবেদন যদি জমা না দিতে পারে সেটাই তারা প্রকাশ করুক। এভাবে ঝুলিয়ে রাখার কোনো মানে আসে না। এত বড় বড় মামলার সমাধান করছে র্যাব। অথচ এই মামলা ১২ বছরেও সমাধান করতে পারলো না। কত খুনের বিচার হচ্ছে, ক্লুলেস কত মামলায় বিচার হচ্ছে। কিন্তু সাগর-রুনির বেলায় এমন হচ্ছে কেন আমার বোধগম্য নয়।
মামলার বাদী মেহেরুন রুনির ছোট ভাই নওশের আলম রোমান জানান, গত ১২ বছর ধরে মামলার প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় চেয়ে নিচ্ছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। প্রতিবেদন জমা না দেওয়া একটি খারাপ সংস্কৃতি চালু হতে যাচ্ছে। দেশে কোনো অপরাধ করলেও বিচার হয় না, এটাই সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে।
সরকার চাইলে সত্য ঘটনা বের করতে পারে। সেখানে ১০৫ বার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় চেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা, আর সেই সময়ও মঞ্জুর হচ্ছে। আমাদের একটাই দাবি প্রকৃত অপরাধী বের হয়ে আসুক, আর বাংলাদেশি আইন অনুযায়ী তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। অনেক বছর হয়ে গেল, এখনও প্রতিবেদন দিতে পারলো না তদন্ত সংস্থা। এটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। এই মামলার দ্রুত একটা সুরাহা হওয়া উচিত। আদালতে প্রতিবেদন আসা মাত্র রাষ্ট্রপক্ষ দ্রুত বিচার শেষ করার চেষ্টা করবে।
এদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আবু সাইদ সিদ্দিকী (টিপু) বলেন, মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পেছানোর জন্য রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ উভয়ে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। আমাদের আশা, তদন্ত সংশ্লিষ্টরা যেন দ্রুত মামলার প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রকৃত খুনিরা বেরিয়ে আসুক।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি নিজেদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এরপর নিহত রুনির ভাই নওশের আলম রোমান রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
প্রথমে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ওই থানার এক উপ-পিরদর্শক (এসআই)। চার দিন পর ডিবি উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলম চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্তভার নেন। এরপর র্যাবের সহকারী পরিচালক মো. ওয়ারেছ আলী মিয়া, সহকারী পরিচালক সহিদার রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জাফর উল্লাহ ও সহকারী পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন আহম্মেদ মামলাটি তদন্ত করেছেন।
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ও ৭ জুন, ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর ও সর্বশেষ ২০১৭ বছরের ২১ মার্চ মামলার অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়। এরপর আর কোনো অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি। অগ্রগতি সংক্রান্ত এসব প্রতিবেদনে প্রায় একই ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
এ মামলায় রুনির বন্ধু তানভীর রহমানসহ মোট ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত অন্য আসামিরা হলেন- বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুন, পলাশ রুদ্র পাল ও আবু সাঈদ। এদের মধ্যে তানভীর ও পলাশ রুদ্র জামিনে আছেন। অন্য আসামিরা কারাগারে। সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার এই ৮ জনের কেউই এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেননি।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ