শেরপুরের নকলায় সাংবাদিক শফিউজ্জামান রানাকে (৪৫) ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৬ মাসের সাজা প্রদানের ঘটনায় সরেজমিন তদন্ত সম্পন্ন করেছেন তথ্য কমিশনার শহীদুল আলম ঝিনুক। রোববার (১০ মার্চ) সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘটনার বিষয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
এদিকে এই ঘটনার তদন্তে তথ্য কমিশনারের নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা রানার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে কার্যালয়ে আসেন।
একই দিনে সাজা দেওয়ার আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে সৃষ্ট উদ্ভুত পরিস্থিতি থামাতে গেলে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল মুনছরের সঙ্গে রানার অশোভন আচরণের প্রতিবাদে সোমবার মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা ডেকেছে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।
এদিকে রোববার স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে তথ্য কমিশনার শহীদুল আলম বলেন, তথ্য চাইতে গিয়ে সাংবাদিক রানাকে সাজা দেওয়া হয়েছে, এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষিতে তথ্য কমিশন একটি বিশেষ সভা করেছে। কমিশনের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে বিষয়টি অনুসন্ধান করা হচ্ছে। সাজাপ্রাপ্ত সাংবাদিক রানা তথ্য চাইতে গিয়ে ওই অবস্থার শিকার হয়েছেন কি না সে বিষয়টি অনুসন্ধান করা হচ্ছে। রানার স্ত্রীর কাছ থেকে দুটি কাগজ পাওয়া গেছে। যা তদন্তে বেশ সহায়ক হবে।
শহীদুল আলম আরও বলেন, ঘটনাটি যেভাবেই হোক না কেন বর্তমানে তা আইনের আওতার মধ্যে এসে গেছে। কাজেই বিচারাধীন বিষয়ে কোনো কমেন্ট করা উচিত নয়। তা বলতে গেলে আইনের বরখেলাপ হবে।
কবে নাগাদ তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে শহীদুল আলম বলেন, তথ্য কমিশন বেশ গুরুত্ব ও দ্রুততার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। তদন্ত শেষ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢাকায় গিয়ে কমিশনের কাছে তদন্ত রিপোর্ট পেশ করবো।
রোববার তদন্তের প্রথম দিনে তথ্য কমিশনার জেলা কারাগারে গিয়ে সাংবাদিক রানার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে তার জবানবন্দি গ্রহণ করেন। এরপর তিনি নকলা শহরের সাংবাদিক রানার ভাড়া বাসায় গিয়ে তার স্ত্রী বন্যা আক্তার ও দশম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে শাহরিয়ার জামান মাহিমের (১৫) সঙ্গে কথা বলেন।
পরে তিনি নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া উম্মুল বানিন, সাজা প্রদানকারী সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শিহাবুল আরিফ ও ইউএনওর সিএ শিলা আক্তারসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেন। এছাড়া তিনি জেলা পর্যায়ে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গেও একান্তে কথা বলেন।
রোববার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে আসা স্থানীয়দের অভিযোগ, রানা সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে চাইতো না। এসএসসি পাসের সনদপত্র অনুযায়ী রানার জন্ম তারিখও দুইটি। তিনি প্রথমে এসএসসি পাস করে বাংলাদেশ সেনাবহিনীতে যোগ দেন। সেখান থেকে তাকে বহিষ্কারের পর এলাকায় এসে নকলা হাসপাতাল রোডে ঘর ভাড়া নিয়ে ওষুধ বিক্রির দোকান দেন। সেখানে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ রোগী দেখেছেন।
একই সময়ে পুনরায় চাকরির আশায় শফিউজ্জামান রানা তার নাম ও বয়স পরিবর্তন করে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। এটা সরকারের কাছে তথ্য গোপনের অপরাধের সামিল। পরবর্তীতে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে চিকিৎসা প্রদানের অভিযোগে তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়।
সেসময় ওই সংবাদ প্রকাশের জেরে স্থানীয় এক সাংবাদিককে মারধর করেন রানা। পরে এই ঘটনায় তার আবারো জরিমানা দিতে হয়। তারপর থেকেই সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া শুরু করেন রানা। প্রথমে ময়মনসিংহ থেকে প্রচারিত আজকের বাংলাদেশ পত্রিকায় কাজ শুরু করলেও দুর্নীতির অভিযোগে তাকে বাদ দেয় কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, গত ৫ মার্চ মঙ্গলবার দুপুরে নকলা ইউএনও কার্যালয়ে প্রবেশ করে সিএ শীলা আক্তারকে নাজেহাল, অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল তছনছ এবং উপজেলা পর্যায়ে দাপ্তরিক এক সভায় ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিনের কর্তব্য কাজে বাধাসহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে সাংবাদিক রানাকে আটক করা হয়। পরে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শিহাবুল আরিফ পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক রানার ছেলে শাহরিয়ার জাহান মাহিম বলেন, ‘সেদিন ইউএনও অফিসে গিয়ে আব্বা একটি কাগজ ওই কার্যালয়ের গোপনীয় শাখার সিএ শীলা ম্যাডামের কাছে জমা দিয়ে অনুলিপি চান। শীলা ম্যাডাম অনুলিপি না দিয়ে অপেক্ষা করতে বলেন।
তখন আব্বা বলেন কতক্ষণ অপেক্ষা করবো সময়টা বলে দেন। তখন ইউএনও ম্যাম বেরিয়ে এসে আব্বাকে ধমকাধমকি করতে থাকেন। একপর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আমার বাবাকে কারাদণ্ড দেন। আমি আমার বাবার মুক্তি চাই এবং ইউএনও’র বিচার চাই।’
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল মুনছর জানান, ‘আমি একটি কাজে ইউএনও অফিসে গিয়েছিলাম। সেখানে বিশৃঙ্খলার আওয়াজ শুনে রানাকে থামাতে গেলে সে আমাকেও মানেনি। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে সাজা দিলে সে তার ছেলেকেও সাজা দিতে বলেছে। এতে বুঝা যায় যে সে ইনটেনশনালি ওইখানে গিয়েছিল।’
নকলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম জিন্নাহ বলেন, ‘রানাতো মূলধারার কোন সাংবাদিক না। সে বিভিন্ন অপকর্ম থেকে বাঁচতে এই সাংবাদিকতার লেবাস ব্যবহার করতো। তার পারিবারিক বিষয় নিয়েও সে ফেসবুকে বিভিন্ন সময় লাইভ করতো। প্রতারণা আর চাঁদাবাজি করে দিন পার করতো সে। আর সাংবাদিকতা নামের মহান পেশাকে সে মানুষ জিম্মি করার হাতিয়ার বানিয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘রানা আগে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত আজকের বাংলাদেশ পত্রিকায় কাজ করতো। তার অপকর্মের জন্য তাকে পত্রিকা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। যদিও সে এখনো আজকের বাংলাদেশ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত আছে বলে ফেইসবুকে পোস্ট করতে দেখা যায়। মাঝে মধ্যে সে সরকারি প্রোগ্রামগুলো ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বয়কট করে। মানুষকে মিথ্যা সংবাদের ভয় দেখিয়ে জিম্মি করে। পরে টাকা দাবি করে।’
রানার স্ত্রী বন্যা আক্তার বলেন, ‘তথ্য কমিশনার মহোদয় আমার কাছে বিস্তারিত সব ঘটনা শুনেছেন। আমি সবই বলেছি। আমার স্বামী পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমার শাশুড়ি অসুস্থ। এর মধ্যে আমার স্বামীকে অন্যায়ভাবে কারাদণ্ড দেওয়ায় সংসারটাই তছনছ হয়ে গেছে। তাই আমার স্বামীর নিঃশর্ত মুক্তি চাই।’
নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া উম্মুল বানিন জানান, তথ্য চাওয়ার কারণে সাংবাদিক রানাকে সাজা দেওয়া হয়নি। সেদিন তথ্য চাওয়ার কোনো বিষয় ছিল না। সরকারি অফিসে এসে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, একজন নারী কর্মচারীকে নাজেহাল ও ফাইলপত্র তছনছের পর ব্যক্তি রানাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। আর ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি যে তথ্য চেয়েছেন সেটি দেওয়া হয়েছে। তথ্য তো মেইলেও দেওয়া যায়, হার্ড কপিতেও দেওয়া যায়।
এদিকে ওই ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হলেও সাংবাদিক শফিউজ্জামান রানার নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে নীরব রয়েছে স্থানীয় ও জেলা পর্যায়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। তবে শেরপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি রফিকুল ইসলাম আধার ও সাধারণ সম্পাদক আদিল মাহমুদ উজ্জল এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
অন্যদিকে রোববার বিকেলে ইউএনওর বিরুদ্ধে অপপ্রচার, অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছে নকলা উপজেলা অফিসার্স ক্লাব ও সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি।
এছাড়া সাংবাদিক রানার কারাদণ্ডের ঘটনার বিষয়ে শনিবার রাতে নকলার ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিন তার সরকারি বাসভবনে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন।ওই সময় তিনি বলেন, সাংবাদিক রানার পরিবার দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর আপিল করতে পারেন এবং জামিনে মুক্তি পেতে পারেন।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ