বাংলা৭১নিউজ, মোঃ মনজুর-ই-মওলা সাব্বির, নাটোর প্রতিনিধি: “এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়”- কবিতারই যেন প্রতিচ্ছবি নাটোরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আমিরুল ইসলাম খান বাবুল। নাটোরের প্রথম ও একমাত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ-ময়নার যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী শহীদ বাবুল পরবর্ত্তীতে সম্ভবত ৭১এর ৩০ এপ্রিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে জনমত গঠন, যুদ্ধে অংশগ্রহন এবং হানাদার বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অংশ হয়ে গেছেন নাটোরের চার ছাত্র নেতা শহীদ রেজা, শহীদ রঞ্জু, শহীদ সেলিম আর শহীদ বাবুল।
কলেজের স্মৃতি সৌধে, কবরের নাম ফলকে, স্যুভেনীড়ের পাতায় সর্বোপরি নাটোরবাসীর মনে চির জাগ্রত থেকে নাটোরে রাষ্ট্র হয়ে আছেন এই চার যুদ্ধ নায়ক। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্য তিনজনের স্বীকৃতি থাকলেও বাবুলের ভাগ্যে রাষ্ট্রীয় এই স্বীকৃতি আজো মেলেনি। শহীদ বাবুলের আতœীয়-স্বজন এবং নাটোরের মুক্তিযোদ্ধারা বাবুলকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি প্রদানের দাবী জানিয়েছেন।
আমিরুল ইসলাম খান বাবুল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক হিসেবে বাবুল ছিলেন অত্যন্ত সক্রিয়। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে নাটোর শহরের মিছিল সমাবেশের আয়োজন এবং প্রচারণায় ছাত্রলীগই ছিলো মূখ্য ভূমিকায়। বাবুলের সহপাঠি অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক জালাল উদ্দিন বলেন, বাবুল পড়াশুনার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতিতে ছিলো অগ্রগামী।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ছাত্রলীগের সহ সভাপতি ও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি এবং পরবর্ত্তীতে নাটোর পৌরসভার চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি এডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, সদা হাস্যোজ্জল ও সাহসী বাবুল দলের দেয়াল লিখন লিখতেন, হাতে লেখা পোষ্টার তৈরী করতেন এবং সমাবেশের মাইকিং করতেন।
২৫ মার্চ ঢাকায় অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ঢাকা থেকে রাজশাহী সেনানিবাসে যাওয়ার পথে নাটোর ও পাবনার সীমান্ত এলাকায় মুলাডুলিতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছত্রভঙ্গ হয়ে সেনাবাহিনীর ৭টি গাড়ি বহর নাটোরের লালপুর উপজেলার আকন্দ সড়ক পথে ময়না গ্রামে ঢুকে পড়ে।
খবর পেয়ে নাটোর ও লালপুরের মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ, আনসার সহ সর্বস্তরের মানুষ ময়না গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে ফেলেন। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। দীর্ঘ সময়ের এই অসম যুদ্ধে শহীদ হন অন্তত ৪০ বাঙালী। বাঙালীদের গড়ে তোলা প্রাণপণ এই প্রতিরোধে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। সাথে তাদের কনভয়ে বেশ কিছু পাকিস্তান সেনার মৃতদেহ।
যুদ্ধে অন্যতম শহীদ সৈয়দ আলী মোল্লার ছেলে ঐ সময়ের কলেজ ছাত্র আবুল হাসেম মোল্লা বলেন, ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যাওয়ার পথে পাকিস্তান সেনাদের মধ্যে মেজর খাদেম হোসেন রাজা সহ ৭ জন গমের জমিতে ধরা পড়েন। উত্তেজিত জনতা তাদের পিটিয়ে হত্যা করেন।
ময়নার যুদ্ধে নাটোর থেকে অংশগ্রহনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বাবুল ছিলেন অন্যতম। যুদ্ধ শেষে আরো সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করতে তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ভারত যাওয়ার। অসুস্থ্য মা’কে নাটোর শহরের কানাইখালী মহল্লার বাসাতে দেখতে এসে ধরা পড়েন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ফুলবাগানে স্থাপিত নির্যাতন কেন্দ্রে। ছেলেকে উদ্ধার করতে ছুটে যান ট্রাফিক পুলিশে কর্মরত বাবা আব্দুর রশীদ খান। এরপর থেকে বাবাসহ বাবুল নিখোঁজ। ৩০ এপ্রিল তাদের দু’জনকে হত্যা করে অন্যসব মুক্তিযোদ্ধাদের মত ফুলবাগান বদ্ধভূমিতে লাশ ফেলে দেওয়া হয় বলে জানান যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স, নাটোরের কমান্ডার শেখ মোঃ আলাউদ্দিন।
মুক্তিযোদ্ধা নবীউর রহমান পিপলু বলেন, সম্ববত ময়না যুদ্ধের প্রতিশোধ নিতেই নাটোরের শহীদ সাগর ও ছাতনী গণহত্যা এবং শহীদ বাবুলসহ হাজারো বাঙালীকে ফুলবাগান নির্যাতন কেন্দ্রে হত্যা করে তাদের লাশ ফূলবাগান বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে হানাদার বাহিনী।
নাটোর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক সংসদ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মজিবর রহমান সেন্টু বলেন, ছাত্রলীগের নিবেদিত প্রাণ শহীদ বাবুল শুধু ময়নার যুদ্ধেই অংশগ্রহন করেনি, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বর্তমান রাণী ভবানী সরকারী কলেজ মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণেও সে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করতো।
নাটোরবাসী জানে, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন এবং প্রাণ হারিয়েছেন নাটোরের চার ছাত্র নেতা। তাই কৃতজ্ঞ মানুষেরা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করে শহীদ রেজা, শহীদ রঞ্জু, শহীদ সেলিম আর শহীদ বাবুলকে। কানাইখালীতে শহীদ রেজা ও শহীদ রঞ্জুর কবরের সাথে নওগাঁতে শহীদ সেলিম এবং নাটোরের ফুলবাগানে শহীদ বাবুলের নামও প্রতিকীভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে। এব্যাপারে উদ্যোক্তা নাটোর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান এডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চার শহীদকে একইসাথে স্মরণ এবং এর আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্যে এই উদ্যোগ।
একাত্তরের পরে নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজের নির্বাচিত ভিপি কলেজ চত্বরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করে শহীদ কলেজের পাঁচ ছাত্রের স্মরণে স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করেন। এই স্মৃতি সৌধে রক্ত আখরে লেখা নাম তালিকায় আছেন শহীদ বাবুল।
নাটোর পৌরসভার ১৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনীতেও ছবিসহ শহীদ বাবুলকে স্মরণ করা হয়েছে। নাটোরের লেখক-সাংবাদিকদের কলমেও চির স্মরনীয় শহীদ বাবুল। এমনকি দেশ স্বাধীনের পরে নাটোরের মুক্তিযোদ্ধারা এক সমাবেশে নাটোর টাউন পার্ককে শহীদ বাবুল পার্ক নামকরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন-যেখানে এখন কেন্দ্রীয় মসজিদ ও হকার্স মার্কেট।
মুক্তিযুদ্ধের স্মরনীয় এই বীর সরকারের শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকায় স্থান করে নিতে পারেননি। এছাড়াও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নিহত শহীদ বাবুলের ট্রাফিক পুলিশে কর্মরত বাবাও স্বীকৃতি পাননি। এর কারন হিসেবে শহীদ বাবুলের ছোট বোন নার্গিস পারভীন বলেন, ১১ ভাই-বোনের মধ্যে বাবুল ছিলো সবার বড়। স্বামী আর বড় ছেলেকে একই সাথে হারিয়ে আমার মা তখন পাগল প্রায়, ছোট আমরাও দিশেহারা। আমরা ছিলাম কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
সম্প্রতি শহীদ বাবুলের আতœীয়-স্বজন এক সংবাদ সম্মেলনে তাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের দাবী জানিয়েছেন। শহীদ বাবুলের ভাগ্নি রোখসানা পারভীন তন্দ্রার ভাষায়, আমরা তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা চাই। কথা বলে জানা গেছে,নাটোরের মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও নাটোরবাসীর দাবীও একই।
বাংলা৭১নিউজ/জেএস