বিশালাকার একটি আম গাছ। দেখতে অন্যান্য আম গাছের মতো হলেও এর আছে বিশেষত্ব। আম গাছটির বয়স বর্তমানে ১৩৪ বছরেরও বেশি। আর এ গাছেই কি-না ৩০০ প্রজাতির আম ধরে।
একই গাছে ধরে আছে গোল, লম্বা, চৌকোসহ লাল, হলুদ, গোলাপি, বেগুনি, কমলা, সবুজ- নানা রঙের নানা আকৃতির আম। পশ্চিমবঙ্গের হিমসাগর, বিহারের ল্যাংড়া, মূল্যবান আলফোনসো আম ইত্যাদি ফলছে একই গাছে। এজন্যই একে বলা হয় জাদুকরি আম গাছ।
উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষ্মৌয়ের মালিহাবাদের এক নার্সারিতে গাছটির অবস্থান। ৮০ বছর বয়সী কলিমুল্লাহ খান গাছটিকে নিজের সন্তানের মতো লালন-পালন করে আসছেন কিশোরকাল থেকে। তিনি ম্যাংগো ম্যান বা আমের মানুষ নামে পরিচিত।
আম খেতে খুব ভালোবাসেন তিনি; তার চেয়েও বেশি ভালোবাসেন নিজের ১০ হাজার হেক্টরজুড়ে গড়ে তোলা আম বাগানকে। তার বিশাল বাগানটি উত্তর ভারতে আম-প্রেমিকের স্বর্গ নামে পরিচিত।
দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ কলিমুল্লাহর এ স্বর্গরাজ্য ও শতবর্ষী আম গাছ দেখতে আসেন। শুধু নিজ দেশেই নয় বরং বিশ্বেও রফতানি হয় কলিমুল্লাহর গাছের আম। টমি অ্যাটকিনস, সুবর্ণরেখা ও হুসেন-এ-আরা আমগুলো ফ্লোরিডায় বেশ জনপ্রিয়।
কলিমুল্লাহর দাদা ১৯০০ সালের দিকে মাত্র ২২ একর জমিতে আম চাষ শুরু করেন। তখন কলিমুল্লাহ খানের বাবাও ছিলেন কিশোর। তিনিও চাষাবাদ শুরু করেন তার বাবার সঙ্গে। এরপর কলিমুল্লাহ হাই স্কুল ছেড়ে বাবার সঙ্গে আম চাষ শুরু করেন। ততদিনে তাদের খামারও বেশ বড় হয়ে উঠেছিল এবং জনবলেরও দরকার ছিল।
এক বন্ধুর বাড়ির গোলাপ বাগানে একই গাছে নানা রঙের গোলাপ দেখে শিহরিত হয়ে উঠেছিলেন কলিমুল্লাহ। তিনি ভাবতে শুরু করেন, একটি ফুল গাছে যদি নানা প্রজাতির ফুল ফোটে; তাহলে এ পদ্ধতি তো ফল গাছেও ব্যবহার করা যাবে। তখন থেকেই আমের গ্রাফটিংয়ের প্রতি কলিমুল্লাহর আগ্রহ জন্মে।
যে-ই ভাবা; সে-ই কাজ। কলিমুল্লাহর যখন ১৭ বছর বয়স; তখন একটি আম গাছে প্রথমবারের মতো তিনি গ্রাফটিং করা শুরু করেন। প্রথমদিকেই তিনি ৭ জাতের আম উৎপাদন শুরু করেন। তবে বন্যার কারণে তার স্বপ্নের গাছটি মারা যায়।
তবে দমে যাননি কলিমুল্লাহ। আরও জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন গ্রাফটিংয়ের বিষয়ে। সাধারণভাবে একটি গাছ থেকে আরেকটি গাছের জন্ম হওয়ার পদ্ধতিকে গাছের বংশ বিস্তার বলে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাছ যৌন কোষ বা তার অঙ্গজ কোষ থেকে নতুন স্বতন্ত্র গাছ সৃষ্টি করে। বর্তমান বিশ্বে এ ধরনের গাছের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ বিষয়ে গবেষণাও হচ্ছে।
প্রথম গাছটি মারা যাওয়ার পর কলিমুল্লাহ খান ১৯৮৭ সালে ১০০ বছরের পুরোনো আম গাছে বিভিন্ন জাতের কাটিং শুরু করেছিলেন। তিনি সারাদেশ থেকে বিরল প্রজাতির আমের নমুনা সংগ্রহ করতেন। এভাবেই শতবর্ষী গাছটি এখন ৩০০ প্রজাতির আম দিচ্ছে। তিনি এটিকে আল মুকারার বা সংকল্প হিসেবে অভিহিত করেন।
কলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘অলৌকিক গাছটি কেবল একটি গাছ নয়, এটি নিজেই একটি উদ্যান, একটি মহাবিশ্ব। একই পিতা-মাতার সন্তানরা যেমন একে অন্যের চেয়ে ভিন্ন হয়; ঠিক তেমনই গাছের প্রতিটি জাতের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য ভিন্ন।’
শুধু গ্রাফটিং নয়, এর পাশাপাশি তিনি নতুন আমের জাতের প্রজনন নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি নতুন জাতের আমের প্রজনন ঘটিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে উৎসর্গ করেছেন (নমো আম) এবং বলিউডের অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রাইয়ের নামেও তিনি নতুন আমের নাম দিয়েছেন।
কলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘আমি বিখ্যাত ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকারের নামেও একটি নতুন আমের প্রজাতি বের করেছি। এ কথা জেনে ক্রিকেটার নিজে আমাকে ফোন করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। মহামারির এ সময়ে দুটি নতুন জাতের আম নিয়ে কাজ করছি। এদের নাম দিয়েছি ‘ডাক্তার আম’ এবং ‘পুলিশ আম’।’
‘আমের মানুষ হিসেবে’ পরিচিত এ ব্যক্তি ভারতের অন্যতম সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী এবং লিমকা বুক অব রেকর্ডসসহ অসংখ্য পুরস্কার জিতেছেন। তিনি গ্রাফটিং শেখানোর জন্য দুবাই এবং ইরান সফর করেছেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবনের সঙ্গে সংযুক্ত মুঘল উদ্যানের জন্য ৫৪টিরও বেশি জাতের একটি আমের গাছ তৈরি করেন।
বাংলা৭১নিউজ/এবি