রাশিয়ান গ্যাসের মূল্য রুবলে পরিশোধ করতে ভ্লাদিমির পুতিন ‘অবন্ধুসুলভ’ দেশগুলোকে চাপ দিচ্ছেন এবং গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেন। ইউরো কিংবা ডলারে মূল্য পরিশোধের বর্তমান যে চুক্তিসমূহ রয়েছে সেসব চুক্তি পুতিন ছিন্ন করতে চাইছেন কি না, সেটি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।
তবে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর ৪০ ভাগ নির্ভরশীল জার্মানি কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছে না। তারা বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাস ব্যবহারকারীদের ইতিমধ্যে সতর্ক করে দিয়েছেন যে এর ফলে স্থবিরতা নেমে আসতে পারে, ক্ষেত্রবিশেষে গ্যাস ব্যবহার সীমিত করার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
আমরা অনুসন্ধান করব রাশিয়ার রপ্তানির ক্ষেত্রে কেন রুবলে মূল্য পরিশোধের বিষয়টি ক্রেমলিনের জন্য একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং পুতিন পরবর্তী সময় তেল, খাদ্যশস্য, সার, কয়লা, ধাতবসহ অন্যান্য বিশেষ পণ্যসমূহেও এ পরিকল্পনা বিস্তৃত করতে পারেন কি না।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে রুবলের মান খাদের কিনারে চলে গিয়েছিল। গত বছর ইউরোর অনুপাতে রুবলের মান যেখানে ৮৫ ছিল সেখানে রাশিয়ার ট্যাংক ইউক্রেনের সীমান্তে ঘোরাফেরা শুরু করা মাত্রই সেটি ১১০-এ পৌঁছে গিয়েছিল। শুধু রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে সেটি ১ ইউরো সমান ৯৪.১ রুবলে এসে দাঁড়ায়।
রুবলের মান এতটা কমে আসায় রাশিয়ার রপ্তানি থেকে কম অর্থ আসতে শুরু করে, যেটি রাষ্ট্রীয় সেবায় ভর্তুকি দেওয়া থেকে শুরু করে যুদ্ধের অর্থ জোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে যেটি প্রত্যাশা করা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক কম। রুবলের মূল্য বেড়ে গেলে সেটি শুধু আরো নগদ অর্থই আনবে না, এটি তাদের জন্য গর্বেরও বিষয় হবে যে রাশিয়ার সঙ্গে যেসব দেশ ব্যবসায়-বাণিজ্য করে থাকে তারা রাশিয়ার রপ্তানির ক্ষেত্রে রুবলে মূল্য পরিশোধ করতে তৈরি থাকবে।
বিদেশি রাষ্ট্র এবং কোম্পানিগুলোর রাশিয়ার পণ্য কেনার পরিপ্রেক্ষিতে বড় অঙ্কের রুবলের যে চাহিদা তৈরি হবে তার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার ডলারের আধিপত্যের বিপরীতে কিংবা বৈশ্বিক আর্থিক বাজারে মস্কোর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার পথ সুগম করবে। যদিও এমন পরিকল্পনাকে চীন কেন সমর্থন দেবে সেটি পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে না।
কিছু কিছু বিশ্লেষকরা এটাও ধারণা করছেন, নিষেধাজ্ঞা জোরদার করার ফলে মস্কোর কাছে ডলার এবং ইউরোর গুরুত্ব কমে আসছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ডলার এবং ইউরোতে আন্তর্জাতিক লেনদেন করতে না পারায় রাশিয়া ইউরোতে নেওয়া ঋণের সুদ রুবলে পরিশোধ করারও প্রস্তাব দিচ্ছে।
রাশিয়া সেসব দেশকে অবন্ধুসুলভ তালিকাভুক্ত করছে যারা তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সেসব অবন্ধুসুলভ দেশের কোনো কোম্পানি কিংবা ব্যক্তির সঙ্গে কোনোরূপ চুক্তি করতে হলে অবশ্যই রাশিয়ার কোনো সরকারি কমিশনের অনুমোদন লাগবে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে আমেরিকা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সদস্যভুক্ত দেশ, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা, নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড এবং ইউক্রেন। এর মধ্যে আমেরিকা এবং নরওয়ে রাশিয়ার গ্যাস কেনে না।
২০২০ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন রাশিয়ার প্রধান ব্যাবসায়িক অংশীদার ছিল। সারা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যের ৩৭.৩ শতাংশই ছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে। এদিকে রাশিয়া ছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ৫ম বৃহত্ ব্যাবসায়িক অংশীদার, এ ব্লকের মোট বাণিজ্যের ৫.৮ শতাংশ ছিল রাশিয়ার সঙ্গে।
যা হোক, আকারে কম মনে হলেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে আড়ালে রেখে দিচ্ছে যে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন যতটুকু রাশিয়া থেকে আমদানি করে থাকে তার বড় অংশই রাশিয়ার গ্যাস যার অধিকাংশই পরিশোধ করা হয় ডলার, ইউরো কিংবা স্টার্লিংয়ে।
Gazprom-এর মতে, ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশে তাদের বিক্রিকৃত ৫৮ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য ইউরোতে পরিশোধ করা হয়েছে। মোট বিক্রির ৩৯ শতাংশ ডলারে এবং ৩ শতাংশ স্টার্লিংয়ে পরিশোধ করা হয়। সারা বিশ্বে পণ্যদ্রব্য বাণিজ্যের বড় অংশই ডলার কিংবা ইউরোতে লেনদেন করা হয়, যার পরিমাণ সব মিলিয়ে বৈশ্বিক মুদ্রা রিজার্ভের ৮০ শতাংশ।
বাস্তবতা হলো, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন রাশিয়ার কাছ থেকে যে গ্যাস আমদানি করে থাকে সেটি পরিবর্তনশীল হলেও, দৈনিক ৮০০ মিলিয়ন ইউরো কিংবা ৬৮০ মিলিয়ন পাউন্ড সেটির পিছনে ব্যয় হয়।
ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর থেকে রাশিয়া যে গভীর সংকটে পতিত হয়েছে, সেটি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে রুবল কেনার এ পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর সুইফট পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবহারে কার্যকরী নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে বিদেশে তাদের যে সম্পদ রয়েছে সেটি তারা ব্যবহার করতে পারবে না। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, মূল্য পরিশোধে তাদের যে হস্তক্ষেপ সেটি ধোপে টিকবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেয়েছিল ডলার এবং ইউরোতে তাদের যে বিনিয়োগ রয়েছে সেটি বিক্রি করে রুবল কিনতে, এর ফলে রুবলের চাহিদা বাড়বে এবং মানও বাড়বে। কিন্তু সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করতে না পারায় তাদের এই উদ্যোগ খুব বেশিদিন টিকে থাকতে সক্ষম হবে না।
অন্য আরেকটি পথও তারা খুঁজে বের করেছে। রপ্তানিকারক, বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যারা রপ্তানি করে থাকে তাদের ওপর বিশেষ নির্দেশনা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। রপ্তানি বিক্রির মাধ্যমে তারা যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে তার ৮০ শতাংশ রুবলে পরিবর্তিত করতে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে।
এখন রাশিয়া তাদের রপ্তানি বাণিজ্যের পুরোপুরিই রুবলে লেনদেন করার বিষয়টি বিবেচনা করছে। যেটি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেমন সার থেকে শুরু করে গাড়ি—সব ক্ষেত্রেই তাদের একপ্রকার একচেটিয়া শোষণকে প্রতিষ্ঠিত করবে। উদাহরণস্বরূপ নিকেলের কথা বলা যেতে পারে, যেটি গাড়ি উৎপাদনকারীরা ক্যাটালিক কনভার্টার তৈরি করতে ব্যবহার করে।
এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংসের হেড অফ করপোরেট রিসার্চ পল ওয়েটার্স জানান, সারা বিশ্বের মোট চাহিদার ৪০ শতাংশ ধাতব আসে রাশিয়া থেকে এবং রাশিয়ার এই ধাতবের ৯০ শতাংশই ব্যবহৃত হয় গাড়ি তৈরির শিল্পে।
যদি গাড়িনির্মাতারা রুবলের বিনিময়ে নিকেল কেনা কিংবা অন্য কোথাও সাপ্লাই খোঁজা—এই দুইয়ের মধ্য থেকে কোনো একটাকে বেছে নিতে বাধ্য হন, তখন রাজনীতিকরা যারা কিনা রাশিয়াকে একঘরে করতে চান, তারা বলবেন অন্য কোথাও সাপ্লাই খোঁজো। ওয়েটার্স আশঙ্কা করছেন, এর ফলে গাড়ি উত্পাদন কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়বে এবং গাড়ির কারখানাগুলো বন্ধও হয়ে যেতে পারে।
ক্রেমলিন যদি বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী ডলার কিংবা ইউরোতে লেনদেনের পরিবর্তে রুবলে লেনদেন করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে, সেটি হবে আন্তর্জাতিক প্রোটোকলের লঙ্ঘন। Gazprom এমন কিছুর আহ্বান করেনি, এমনকি স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিমাদের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছে গিয়েছিল তখনো তারা এমন কিছু করার ঔদ্ধত্য দেখায়নি।
জার্মানি বলছে, তারা এনার্জি সাপ্লাইয়ের ক্ষেত্রে বরাদ্দ দিতে প্রস্ত্তত, তবুও তারা রুবলে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করবে না। এর ফলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বৃহত্তর অর্থনীতির দেশটিতে মন্দা নেমে আসার আশঙ্কাও দেখা দিতে পারে, তারপরও তারা রাশিয়াকে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করবে না। ক্রেমলিনের এই পদক্ষেপও রাশিয়া থেকে নিত্যপণ্যের বাজার অন্যত্র সরে যাওয়ার বিষয়টিকে ত্বরান্বিত করছে, যেটি ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হওয়া দেশটিকে আরো নিমজ্জিত করবে।
লেখক: ইকোনমিকস এডিটর, দ্য অবজারভার
দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর: এইচ এম নাজমুল আলম
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ