বিএনপির মহাসমাবেশকে সামনে রেখে বুধবার রাতভর রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক হোটেল ও বাসাবাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। এ সময় বিএনপির কয়েকশ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। নয়াপল্টনের একটি আবাসিক হোটেল থেকেই অন্তত দেড়শ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। এ ছাড়া ঢাকার পার্শ্ববর্তী দুই জেলা নারায়ণগঞ্জ ও সাভারেও ধরপাকড় হয়েছে।
এ নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পুলিশ বলছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এই অভিযান। এ বিষয়ে ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, রাজধানীজুড়েই ডিবির বিভিন্ন টিম অভিযান চালাচ্ছে। মোট কতজন গ্রেফতার হয়েছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ অভিযান চলমান।
রাত ১টা ৩৫ মিনিটে ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ঢাকা শহরজুড়ে বিএনপির ৫০টি থানা এলাকায় অভিযান চলছে। থানা পুলিশ এ অভিযান চালাচ্ছে। কোথাও কোথাও ডিবি থানা পুলিশকে সহযোগিতা করছে। গ্রেফতারকৃত কোনো আসামি ডিবি হেফাজতে নেই। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ মাঝেমধ্যে বিশেষ অভিযান চালায়। এরই অংশ হিসাবে অভিযান চলছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, দলের কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুস, দিনাজপুর জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মোফাজ্জল হোসেন দুলালসহ ১৫৫ নেতাকর্মীকে হোটেল মিডওয়ে (নয়াপল্টন) থেকে রাতে তুলে নিয়ে গেছে পুলিশ। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি জানান তিনি।
বিএনপি সূত্র জানায়, মিরপুর থানা পুলিশ পাংশা উপজেলা ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি সজিব রাজা, ছাত্রদল নেতা ইমরান হোসেন, কলিমহর ইউনিয়ন ছাত্রদলের জাহিদ হোসেন, মৌরাট ইউনিয়ন ছাত্রদলের কনকসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে। কলাবাগান থানায় গ্রেফতার হয়েছেন জয়পুরহাট জেলা শাখা জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের সদস্য সচিব মঞ্জুরে মওলা পলাশ ও ছাত্রদল নেতা মশিউর রহমান খন্দকার (এ্যালট)।
সরকার পতনের একদফা দাবিতে বৃহস্পতিবার বিএনপি ও সমমনা দল এবং জোটের পক্ষ থেকে রাজধানীতে ডাকা হয়েছিল মহাসমাবেশ। এর বিপরীতে সরকারদলীয় ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে সমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
নির্বাচন কমিশন বাতিলসহ নানা দাবিতে এদিন বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে সমাবেশ করতে চায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এছাড়া বিজয়নগরে প্রতিবাদী অবস্থান বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করে এবি পার্টি। ওইদিন বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশের সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করে জামায়াতে ইসলামী। একইদিনে কাছাকাছি সময়ে ও স্থানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিকে ঘিরে তৈরি হয় উত্তেজনা।
এমন বাস্তবতায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোকে কাঙ্ক্ষিত স্থানের বাইরে কর্মসূচি পালনের পরামর্শ দিয়ে কড়া সতর্কাবস্থান নেন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। বুধবার রাতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, তারা বৃহস্পতিবার কর্মসূচি পালন করবে না। শুক্রবার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করবে।
এই মহাসমাবেশে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে পুলিশ অ্যাকশনে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচিকে ঘিরে কয়েকদিন ধরেই পুলিশ সদর দপ্তর এবং ডিএমপি সদর দপ্তরে দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব বৈঠকে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যাদের নামে মামলা আছে বা রাজনৈতিক দলের যেসব নেতাকর্মীর নামে ওয়ারেন্ট আছে তাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ইতোমধ্যে অভিযান শুরু হয়েছে।
কর্মসূচিস্থল ও আশপাশসহ ঢাকা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুলিশি পোশাকের পাশাপাশি সাদা পোশাকে মাঠে নেমেছেন বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য। ইতোমধ্যে নজরদারি শুরু করেছেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। পুলিশের সাইবার ইউনিট চোখ রাখছে সাইবার জগতে। কেউ যাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন বলেন, শুধু পুলিশ নয়; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সঙ্গে ইতোমধ্যে সমন্বয় সভা করেছি। কোনো ঘটনা ঘটলে র্যাব, বিজিবি এবং আনসারসহ মাঠে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যৌথভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। তিনি বলেন, কর্মসূচির দিন সাপ্তাহিক কর্মদিবস হওয়ায় মহানগরে অনেক জনসমাগম হবে। এ কারণে তীব্র যানজটে জনসাধারণের ভোগান্তি বাড়ার আশঙ্কা আছে। এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েও নিরাপত্তা ছক প্রণয়ন করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন-হোটেল, রেস্টুরেন্টে যেন কোনো নাশকতাকারী বা অপরাধী চক্র লুকিয়ে থাকতে না পারে সেজন্য নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে। ঢাকার বাইরে থেকে যেন কোনো অপতৎপরতাকারী ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারেও মাঠপর্যায়ে সতর্ক করা হয়েছে।
অপরদিকে বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে প্রস্তুত করা এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্টের অপতৎপরতা চালানো হতে পারে। মহাসমাবেশের মাধ্যমে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ব্যাপক শোডাউনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গন ও জনগণের কাছে একদফার গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি তুলে ধরবে। এক্ষেত্রে হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস কর্মসূচির দিকে নাও যেতে পারে।
কর্মসূচিকে ঘিরে সারা দেশ থেকে ইতোমধ্যে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ঢাকায় এসেছেন। কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল যেন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে না পারে সেজন্য জঙ্গিগোষ্ঠীর ওপর সতর্ক নজরদারি প্রয়োজন বলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিরোধে সুবিধাজনক স্থানে সন্দেহজনক যানবাহন তল্লাশির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
ডেমরা থানার ওসি মো. শফিকুর রহমান বলেন, মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাতে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিএনপির ১২ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছি। বুধবার দুপুরে তাদের আদালতে পাঠানো হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলো-নুর হোসেন জনি, কবির হোসেন খান, আতাউর রহমান খান রোমান, হোসেন আলী, মো. শহিদুল্লাহ, রফিক আহম্মেদ, সাব্বির আহম্মেদ সুমন, শহিদুল ইসলাম বাবু, হাজী হযরত আলী, মো. শফিক, মো. আসিফ, নাইম ইসলাম ওরফে আকরাম ও মো. হোসেন। তারা সবাই গত মে মাসে করা ডেমরা থানার দুটি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।
বাংলা৭১নিউজ/এবি