বাংলা৭১নিউজ,ঢাকা: বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের প্রধান একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো যানজট। গত বছর এক জরিপে উঠে আসে যানজটে শুধু ঢাকায় নষ্ট হচ্ছে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা, যার বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। এ সময় যানজট নিরসনে রাইড শেয়ারিং নিয়ে সবার মাঝে আগ্রহ তৈরি হয়। রাইড শেয়ারিং বলতে আমরা পাঠাও আর উবার প্রতিষ্ঠানকে চিনলেও এর বাইরেও রয়েছে সহজ, ও ভাই, পিক মি, যাত্রীসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান। একদিকে খুব অল্প সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিতর্কিত অ্যাপসভিত্তিক এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অন্যদিকে কোনো নীতিমালার তোয়াক্কা না করায় নানা আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। আর বিরোধিতার ঝড় তুলছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো। দ্বন্দ্বটা কী নিয়ে, ব্যবসা না যানজট?
যানজটে ব্যক্তিগত গাড়ি: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে ঢাকার রাস্তায় বছরে ৯০ হাজার নতুন গাড়ি নামে, এসব গাড়ির ৮০ শতাংশই ব্যক্তিগত ব্যবহারের। ব্যক্তিগত গাড়িগুলোই এ যানজটের অন্যতম কারণ উল্লেখ করা হয়। গবেষণা অনুযায়ী রাজধানীতে বর্তমানে গাড়ি রয়েছে সাড়ে ১৩ লাখ। এর মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা সাড়ে ১০ লাখ। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন যোগ হয় ২৫০টি গাড়ি। অর্থাৎ বছরে ৯০ হাজার। ফলে ঢাকায় প্রতিদিনই বাড়ছে গাড়ির চাপ, বাড়ছে যানজট।
যানজট নিরসনে সরকার: বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে গাড়ি। তবে উল্লেখযোগ্য হারে রাস্তা বাড়ানো সম্ভব নয়। তাই যানজট নিরসনে সরকারের রয়েছে নানা পদক্ষেপ। যেমন গাড়ির শুল্ক বৃদ্ধি, যেন লাগামহীন গাড়ির ব্যবহার রোধ করা যায়। আবার একই পরিবারে একাধিক গাড়ি থাকার ফলে জোড়-বিজোড় সিরিয়াল করে রাস্তায় নামানোর দিন নির্ধারণ। বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে চলছে মেট্রোরেল ও ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ। এছাড়া রাস্তায় সরকারি বাস নামানোর উদ্যোগ।
রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান: যখন যানজটে নগরবাসী উত্কণ্ঠায়, তখন রাইড শেয়ারিংয়ের ছোট কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এ সময় সরকারি সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় অনুমোদন পায়নি তারা। অন্যদিকে বাইরের বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে একটি প্রস্তাবনা দাখিল করেই শুরু করে তাদের কার্যক্রম। প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়, কোনো আইন প্রণীত হলে তখন সেই নীতিমালা অনুসরণ করেই চলবে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম। প্রথম দিকের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক সমাদৃত হয়। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত মানের অ্যাপস তৈরিতে নানা ফিচার সংযোজন করে। একই সঙ্গে গ্রাহক ও চালককে আকৃষ্ট করতে চলে প্রতিযোগিতা।
নীতিমালা: সুপরিকল্পিতভাবে সেবা কার্যক্রম চালাতে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি নীতিমালা বেঁধে দেয়া হয়, যা ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা-২০১৭’ নামে অভিহিত। এ নীতিমালায় প্রাধান্য পেয়েছে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার শর্তাবলি, দায়দায়িত্ব, নির্দিষ্ট মূল্য পরিশোধে ও শর্তসাপেক্ষে এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট গ্রহণ ও নবায়ন, ভাড়ার হার নির্ধারণ, আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি।
নীতিমালায় উল্লিখিত প্রস্তাবনা: দেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন হালকা মোটরযান যেমন মোটরসাইকেল, মোটরকার, জিপ, মাইক্রোবাস ইত্যাদি সাধারণত একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবার ব্যবহার করে। ব্যক্তি মোটরযানের এরূপ সীমিত ব্যবহারের কারণে দেশে হালকা মোটরযানের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এ সংখ্যা মহানগরীতে ব্যাপকভাবে বেড়ে যানজট সৃষ্টি করেছে। এতে জনসাধারণের মূল্যবান শ্রমঘণ্টা ও জ্বালানির অপচয়সহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ। রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের মাধ্যমে ব্যক্তিগত মোটরযান ব্যক্তিমালিক কর্তৃক ব্যবহারের পর অতিরিক্ত সময়ে ভাড়ার বিনিময়ে যাত্রী বহনের সুযোগ পেলে একদিকে সড়কে মোটরযানের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে, অন্যদিকে যানজট হ্রাসেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ব্যক্তিগত মোটরযান মালিক আর্থিক সুবিধাও পাবেন।
বর্তমান রাইড শেয়ার: বর্তমানে রাইড শেয়ারিংয়ের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশ চালক ঢাকার বাইরে থেকে এসে কর্মসংস্থানের তাগিদে চালকের দায়িত্ব পালন করছেন। কেউ আবার ধার-দেনায় বা লোনের মাধ্যমে মোটরযান ক্রয় করে রাইড শেয়ারকে পেশায় পরিণত করেছেন। ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়িগুলো শুধু কর্মক্ষেত্রে আসা-যাওয়ায় দুবার রাইড শেয়ার করে থাকে। এর সংখ্যাও তুলনামূলক খুবই নগণ্য।
সৃষ্ট সমস্যা: ব্যক্তিগত ব্যবহারিক গাড়িগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত না হয়ে বাণিজ্যিক আকারে মোটরযান ক্রয়ের হিড়িক পড়েছে, যা আগের যানজট সমস্যাকে আরো প্রকট করে দিচ্ছে। বাণিজ্যিক রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে বেকারত্ব ঘোচাতে জনসমুদ্র ঢাকায় পাড়ি জমাচ্ছে নতুন মুখ। অদক্ষ বা নতুন চালকে ঢাকায় বেড়ে চলছে দুর্ঘটনার মাত্রা। ব্যক্তিগত মোটরযানগুলো কর্মস্থানে যাওয়ার বা আসার পর পার্কিং সুবিধা থাকলেও রাইড শেয়ারের যানবাহন কর্মের ফাঁকে যেখানে সেখানে পার্ক করা হচ্ছে, যা থেকে মূল রাস্তা ও অলিগলির স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয়।
উল্লেখ্য, রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসার প্রচার ও প্রসারের স্বার্থে নানা কর্মকাণ্ডে অতুলনীয়। এদিকে সরকার এদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে। তবে যানজট নিরসনে এসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা তখনই কার্যকর হবে যদি ‘গেজেটে উল্লিখিত প্রস্তাবনা’ অনুসরণ করা যায়। অর্থাৎ যেসব ব্যক্তিমালিকানাধীন মোটরযান রয়েছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা।
বাংলা৭১নিউজ/এম.এ