গত ৬ বছরে অন্তত ১২ জন প্রাণ হারিয়েছেন পাবনা সদর উপজেলার ভাঁড়ারায়। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়েছে এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু সাঈদ খাঁন ও তার প্রতিপক্ষ সুলতান মাহমুদ খাঁনের নাম। মারা গেছেন সুলতান মাহমুদ খানের বাবা ও চাচাতো ভাই। চেয়াম্যান পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন আবু সাঈদ।
সর্বশেষ ভাঁড়ারা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে শনিবার (১১ ডিসেম্বর) এ দু’ গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে চেয়ারম্যান পদের স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াছিন আলী (সুলতান মাহমুদের চাচাত ভাই) নিহত হয়েছেন। সব মিলিয়ে এখন আতঙ্কের জনপদের নাম ভাঁড়ারা। আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এ বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে আঞ্চলিক রাজনীতির প্রতিহিংসার শিকার হন আমিরুল ইসলাম প্রামাণিক (৩০) নামে এক যুবক। তাকে ভাড়ারা ইউনিয়নের আতাইকান্দা মুজিববাঁধ সংলগ্ন ভাউডাঙ্গা মোড়ে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা। নিহত আমিরুল ভাড়ারা ইউনিয়নের কাথুলিয়া গ্রামের মো. মুন্তাজ প্রামাণিকের ছেলে।
আমিরুল এলাকায় সুলতান আহম্মেদ খানের সমর্থক ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পরদিন মরদেহ নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে এলাকাবাসী। এ সময় বিক্ষোভকারীরা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ খানসহ তার লোকজনকে গ্রেফতারের দাবি জানান।
এর আগে ২০২০ সালের ৬ জুন ভোরে ৯০ বছরের বৃদ্ধ হুকুম আলি খাঁকে নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করে প্রতিপক্ষের দুর্বৃত্তরা। নিহত হুকুম আলী একদিন আগে বাদী হয়ে পাবনা সদর থানায় সুলতান খাঁনকে প্রধান আসামি করে ১৫ জনের নাম দিয়ে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। এর পরদিনই হুকুম আলী এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
অভিযুক্ত সুলতান খাঁন সেসময় ফেসবুক লাইভে এসে বলেছিলেন, ‘আমি সাঈদ বাহিনীর ষড়যন্ত্রের শিকার। আমাকে ফাঁসাতে সাঈদ ও তার লোকজন এ ঘটনা সাজিয়েছে।’
ভাঁড়ারায় সবচেয়ে আলোচিত ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বরের জোড়া খুনের ঘটনা। ওই দিন সন্ধ্যায় সুলতান খাঁনের বাবা মহসীন খান লস্কর (৬৮) ও তার প্রতিবেশী চাচা আব্দুল মালেককে (৪০) গুলি করে খুন করে প্রতিপক্ষের লোকজন। এ সময় দুই নারীসহ ১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।
এদিকে ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তথ্য সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অসদাচারণের অভিযোগে পাবনার ভাঁড়ারা ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাইদ খানকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
মূলত আবু সাঈদ খাঁন ও সুলতানের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে। ওই বছরের ১৮ মার্চ পাবনা সদর উপজেলার ভাঁড়ারায় চেয়ারম্যান প্রার্থী আবু সাঈদ খাঁনের বাড়িসহ ৭টি বাড়িতে হামলা এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সেসময় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আবু সাঈদ খান এবং আওয়ামী লীগ নেতা সুলতান খাঁনের মধ্যে বিরোধ চলছিল। ওই ঘটনার পর থেকেই এ দুই আওয়ামী লীগ নেতার দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
স্থানীয়রা জানান, পাবনা জেলার প্রাচীন জনপদ হিসেবে ভাঁড়ারার ঐতিহ্য ছিল। ভাঁড়ারার মসজিদ পাবনা জেলার মধ্যে একটি দর্শনীয় নিদর্শন। ১৭৫৭ সালে বাদশাহ শাহ আলমের সময় দৌলত খার পুত্র আসালত খা ভাঁড়ারা শাহী মসজিদ নির্মাণ করেন। ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি যা শুধু মাত্র গম্বুজ দ্বারা বেষ্টিত। পদ্মা নদীর পাড়ে অবস্থিত ভাঁড়ারা শাহী মসজিদ। লোকশ্রুতি রয়েছে, ঐতিহাসিক শাহী মসজিদ এক রাতে নির্মাণ হয়েছিল।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভাড়ারা পদ্মা নদীর চর এলাকা হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে ব্যাপক বালি উত্তোলন হয় ওই এলাকায়। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় প্রতিদিন শ শ ট্রাক বালি উত্তোলন করা হয়। আর এই বালি উত্তোলনকে কেন্দ্র করেই সাঈদ-সুলতান গ্রুপের মধ্যে ঝামেলা চলে আসছে। একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেন পাবনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ ও অপর গ্রুপের নেতৃত্ব দেন জাসদ থেকে আওয়ামী লীগে আসা সুলতান আহমেদ।
এখন ভাঁড়ারা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে আবার উত্তাল হয়ে উঠেছে এলাকা। কোন্দল আর দখলবাজি, বালু মহালে খবরদারি ও প্রভাব দেখাতে এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর চড়াও হচ্ছে। আবু সাঈদ আওয়ামী লীগ থেকে এবারও দলীয় মনোনয়ন পাওয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন সুলতান খাঁন। এনিয়েও নির্বাচনী সহিংসতা বেড়েছে। এর সর্বশেষ বলি হলেন সুলতান খাঁনের চাচাত ভাই ও স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী ইয়াছিন আলী।
পাবনা সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আলহাজ্ব মোশাররফ হোসেন এবং যুবলীগের পাবনা জেলার সাবেক সভাপতি ও পাবনা পৌর মেয়র শরীফ উদ্দিন প্রধান রোববার (১২ ডিসেম্বর) নিহত চেয়ারম্যান প্রার্থী ইয়াছিন আলীর নামাজের জানাজায় শরিক হন।
জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে আলহাজ্ব মোশাররফ হোসেন বলেন, ভাঁড়ারা ইউনিয়নের পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে সাঈদ চেয়ারম্যান অস্ত্র ও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তিনি তার টাকা ও ক্ষমতার দাপটে সাধারণ জনগণের ওপর গুলি চালাচ্ছেন। সাঈদ চেয়ারম্যান বারবার এমন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চেয়ারম্যানের পদ দখল করে থাকতে চান। প্রশাসনের কাছে এই হত্যার সুষ্ঠু বিচার দাবি করে তিনি।
পাবনা পৌর মেয়র শরীফ উদ্দিন প্রধান বলেন, সাঈদ চেয়ারম্যান এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে বারবার এলাকায় তিনি খুন করছেন। শহরের ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের নিয়ে এসে এলাকায় সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম করেছেন।
জাসদের সাবেক আঞ্চলিক নেতা ও বর্তমানে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা সুলতান মাহমুদ খান বলেন, ২০১৬ সালে বর্তমান চেয়ারম্যানের প্রতিপক্ষ হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এরপর থেকে আমার পরিবারের বাবা-ভাইসহ এলাকার ১১-১২ জন নেতা-কর্মী-সমর্থক খুন হয়েছেন। সাঈদ খাঁনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই খুন হতে হয়। খুন করে প্রশাসনের চোখের সামনে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ান তিনি।
তবে আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ খান বলেন, আমার প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসীরা ষড়যন্ত্র করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। আমি চারবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান, আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
তিনি বলেন, প্রশাসনের কাছে অনুরোধ এই হ্যতাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত হোক। এসব ঘটনার সঙ্গে তার কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই। সুলতান খাঁন অহেতুক তাকে জড়িয়ে মিথ্যাচার করে থাকেন।
পাবনা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) রোকনুজ্জামান বলেন, খুনের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করা হবে। তারা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছেন।
বাংলা৭১নিউজ/এসএফ