বাংলা৭১নিউজ,ডেস্ক: বাংলাদেশের ফৌজদারি আইনে তথ্য গোপন করে একাধিক বিয়ে একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। তারপরও এখানে পরিচয় গোপন রেখে কিংবা আইনের ফাঁক গলে একাধিক বিয়ের ঘটনাতো আকছার ঘটেই, এমনকি এক ব্যক্তির শতাধিক বিয়ের খবরও পাওয়া যায়।
ঢাকার বিমানবন্দরে সম্প্রতি প্রবাসফেরত এক ব্যক্তিকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া নিয়ে দুই স্ত্রীর বাদানুবাদ, ধাক্কাধাক্কি ও টানা-হেঁচড়ার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়।
ভিডিও দেখে বোঝা যাচ্ছে, প্রথম বিয়ের তথ্য গোপন করে ওই ব্যক্তি দ্বিতীয় বিয়ে করেন, এবং দেশের ফেরার পর তাকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে এসেছেন দুই স্ত্রীই।
খবরের কাগজে মাঝেমধ্যেই এ ধরণের খবর ছাপা হতে দেখা যায়।
খবরে তথ্য-পরিচয় গোপন করে প্রতারণা করে বহু বিবাহের ঘটনা নিয়ে অনেক হাস্যরসও হয়, যেমন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ‘বিয়ে পাগল’ উপাধি দিয়ে দেয়া হয়।
২০১৯ সালের নভেম্বরের শেষদিকে ঢাকার তেজগাঁও থানার পুলিশ জাকির হোসেন ব্যাপারি নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেন, যিনি তথ্য-পরিচয় গোপন করে, প্রতারণা করে ২৮৬টি বিয়ে করেছেন।
এই বিপুল সংখ্যক বিয়ে করার জন্য তিনি ১৪ বছর সময় নিয়েছেন।
ওই মামলার তদারককারী কর্মকর্তা তেজগাঁও থানার ইন্সপেক্টর অপারেশনস হাসনাত খন্দকার বিবিসিকে জানিয়েছেন, তদন্ত করে মামলার চার্জশীট দিয়েছে পুলিশ, এখন সেটি আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় আছে।
“আমরা তাকে ধর্ষণ এবং প্রতারণার মামলায় গ্রেফতার করেছিলাম। জিজ্ঞাসাবাদে সে ২৮৬টি বিয়ের কথা আমাদের কাছে স্বীকার করেছে।
বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সে বিয়ে করত এবং স্ত্রী ও তাদের পরিবারের কাছ থেকে নানা উছিলায় টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিত।”
তিনি জানিয়েছেন, গ্রেফতারের পর পুলিশ যখন তদন্ত শুরু করলে যখন ওই ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ হয়, তখন তার বিরুদ্ধে একই সময়ে প্রতারণামূলক বিয়ের অভিযোগে ঢাকার মিরপুর, গাজীপুর, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলায় মোট ৬টি মামলা হয়েছিল।
মি. খন্দকার জানিয়েছেন, তদন্তে তারা দেখতে পেয়েছেন, এসব বিয়ের জন্য ভুয়া কাজী এবং ভুয়া কাগজপত্র প্রস্তুত করে বিয়ে করতেন ওই ব্যক্তি।
পুলিশ কর্মকর্তা মি. খন্দকার জানিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রতারণা করে বিয়ে করার অভিযোগ অনেক পান তারা।
অনেক ক্ষেত্রে মামলাও হয়না, সমঝোতার মাধ্যমে অনেকে মিটিয়ে নেন।
তবে, তিনি জানিয়েছেন, এসব প্রতারণার অভিযোগ কেবল পুরুষ নয়, নারীদের বিরুদ্ধেও পাওয়া যায়।
“মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান—সব ধর্মেই কমবেশি বিয়ের অভিযোগ পাওয়া যায়।”
তবে বছরে এ ধরণের প্রতারণার কতগুলো ঘটনা ঘটে, কিংবা কতগুলো মামলা হয় সে নিয়ে সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। কেবল গণমাধ্যমে আলোচিত হলেই সেগুলো সামনে আসে।
বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্টার সমিতির মহাসচিব কাজী ইকবাল হোসেন জানিয়েছেন, বর্তমানে যেভাবে ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন হয়, তাতে এধরনের প্রতারণা বন্ধের উপায় বলতে গেলে নেই।
“আমাদের কাছে যে ধরণের তথ্য বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হয়, তাতে বিয়ের পূর্ব ঘটনার কোন রেফারেন্স থাকে না। যেমন ধরেন জাতীয় পরিচয়পত্র বা ভোটার আইডি এবং জন্ম নিবন্ধন সনদ—এর কোথাও তো ব্যক্তির বৈবাহিক অবস্থার উল্লেখ থাকে না।”
সাধারণ ক্ষেত্রে বিবাহ নিবন্ধনের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র এবং জন্ম নিবন্ধন সনদ চাওয়া হয়।
এর সঙ্গে পূর্বে বিবাহিত হলে প্রথম স্ত্রীর অনুমতিপত্র, বা অনুমতি দিয়ে চেয়ারম্যানের সনদ, এবং তালাক-প্রাপ্ত হলে সে সংক্রান্ত সনদ চাওয়া হয়।
মি. হোসেন বলছেন, “কিন্তু কেউ প্রতারণা করতে চাইলে এসব কোন নিয়ম দিয়েই আটকানো যায় না। কারণ কেউ যদি সব অস্বীকার করে, কিভাবে সেইটা ঠেকানো যাবে? বর্তমানে দেশে তো সে ব্যবস্থা নাই।”
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে বা প্রতারণা করে বিয়ে করা খুবই সহজ।
এর কারণ হিসেবে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, প্রধানত আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করেই এ ধরণের প্রতারণার ঘটনা ঘটে।
“প্রধান কারণ হচ্ছে, দেশে সেন্ট্রাল ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন বা বিয়ে নিবন্ধন বিষয়ক কেন্দ্রীয় কোন ব্যবস্থা নেই।”
“বিবাহ নিবন্ধনের তথ্য যদি ডিজিটালাইজড হত অর্থাৎ অনলাইনে বিষয়টি যাচাই করার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে এসব প্রতারণা ঘটনা অনেক কমে আসত।”
বিবাহ নিবন্ধনের তথ্য অনলাইনে দেখা গেলে, প্রথম বিয়ের পর কেউ পুনরায় বিয়ে করতে গেলে, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সেটা রেজিস্টারে দেখা যেত।
ফলে প্রতারণাটা ধরা পড়ে যেত, যা এখন ধরার উপায় নেই।
“ধরুন কেউ রংপুরে একটি বিয়ে করেছে, তথ্য লুকিয়ে পরের বিয়েটি কুষ্টিয়া বা সিলেটে বা চট্টগ্রামে করলো, এখন সেখানকার লোকে এটা যাচাই করবে কোথায়?”
তিনি বলেছেন, আইন অনুযায়ী দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি বা চেয়ারম্যানের অনুমতিপত্র লাগে।
“কিন্তু বিয়ে নিবন্ধনের সময় সেটা নিয়েও অনিয়ম হয়, মানে প্রায়ই দেখা যায় সেটা না দেখেই বিয়ে দেয়া হয়েছে। অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজেকে অবিবাহিত দাবি করে মিথ্যা তথ্য দিল, সেটাও তো বিয়েশাদীর সময় তাড়াহুড়ায় যাচাই করার উপায় থাকে না।”
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটও এ ধরণের প্রতারণার ঘটনার জন্য কিছুটা দায়ী বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেছেন, বাংলাদেশের সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থানের কারণে এমন ঘটনা ঘটে।
“এখানে অবস্থাটা এরকম যে, সাধারণভাবে মেয়েকে কোনভাবে পার করতে পারলেই বাঁচে বাবা-মায়েরা। দেখা যায় ছেলে বিদেশে থাকে, সেখানে কি কাজ করে, কী তার পূর্ব ইতিহাস—কোন কিছু যাচাই না করে বিয়ে দেয়া হয়। এটা কেবল গ্রামে নয়, শহরেও ঘটে। উচ্চ শিক্ষিত পরিবারেও ঘটে।”
“এছাড়া সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়েও পরিবারে এক ধরণের উদ্বেগ থাকে, যে কারণে পরিচয় এবং ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই না করে বিয়ে দিয়ে প্রতারণার অনেক ঘটনা ঘটে।”
পুলিশ বলছে অনেক সময় নিবন্ধন না করেও বিয়ের ঘটনা ঘটে।
কিন্তু ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন অনুযায়ী বিবাহ রেজিস্ট্রেশন না করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
প্রতিটি বিবাহ সরকার নির্ধারিত কাজির কাছে রেজিস্ট্রেশন না করা হলে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও তিন হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড হতে পারে।
তবে এক্ষেত্রে বিয়েটি বাতিল বলে গণ্য হবে না।
এছাড়া হিন্দু খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের জন্যও বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের বিধান রয়েছে।
কিন্তু বেশিরভাগ সময় দেখা যায় মানুষ বিবাহ রেজিস্ট্রেশন সম্পর্কে ঠিকমত জানেন না।
সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বাংলাদেশে এ ধরণের প্রতারণা করে বিয়ে বন্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
“যেহেতু বাংলাদেশে এখনো অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ অর্থাৎ পরিবারিকভাবে দেখাশোনার মাধ্যমে বিয়ে বেশি হয়, ফলে এসব প্রতারণা বন্ধের জন্য একটি ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্যে আমরা বিবাহ রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা অনলাইন করার কথা ভাবছি। সেই সঙ্গে আরেকটি হচ্ছে বিয়ের জন্য বাধ্যতামূলক জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রদর্শন, যেটা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।”
আইনমন্ত্রী মনে করেন এতে প্রতারণা কমে যাবে বা বন্ধ হবে। তবে, কবে নাগাদ ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা অনলাইন হবে, সেটি তিনি বলতে পারেননি।
“টাইম ফ্রেম আমি দিতে পারবো না, কিন্তু এটা বলতে পারি আমরা (সরকার) খুব সিরিয়াস এ ব্যাপারে।”
এই মূহুর্তে বাল্যবিবাহ বন্ধের উদ্দেশ্যে জন্ম নিবন্ধন সনদ ব্যবহার হচ্ছে।
বাংলা৭১নিউজ/সূত্র: বিবিসি অনলাইন