কক্সবাজারের টেকনাফে কোনো ব্যক্তি অপহরণের শিকার হলে ডাকাত দলকে মুক্তিপণ দিয়েই বাড়ি ফিরতে হয় ভিকটিমকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরেও খুব একটা উপকার পান না ভুক্তভোগীর স্বজনরা। এসব অপহরণের ঘটনায় পাহাড় সংলগ্ন গ্রামের কৃষক-শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের মধ্যে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ডাকাতের হাতে অপহরণের শিকার হয়ে মুক্তিপণের বিনিময়ে ফেরত আসা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টেকনাফ, শামলাপুর, হ্নীলা, দমদমিয়া, হোয়াইক্যং, কানজর পাড়া, খারাংখালি, আলী খালী, রঙ্গিখালী, জাহাজপুরাতে রোহিঙ্গা ও বাঙালি মিলে কয়েকটি ডাকাত গ্রুপ করে পাহাড়ে অবস্থান করছে। পাহাড়ি এলাকার কাছাকাছি বসবাসকারী গ্রামের কৃষক, কাঠুরিয়া, শ্রমিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষকে তারা টার্গেট করে। সুযোগ বুঝে ধরে পাহাড়ে তাদের আস্তানায় নিয়ে যায়।
এসব আস্তানা অনেক দুর্গম। ডাকাত দলের সদস্যরা ধরে নিয়ে গিয়ে হাত-পা ও চোখ বেঁধে রেখে অপহৃত ভিকটিমের মোবাইল থেকে ফোন করে পরিবারের কাছে মুক্তিপণের টাকা দাবি করেন। টাকা না দিলে নির্যাতন করে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদেরকে আহাজারি শোনায়। আর এতেই নির্যাতন থেকে ভিকটিমকে রক্ষা করতে ডাকাত দলকে টাকা দিতে বাধ্য হয় পরিবার।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনেক সময় অপহৃতদের উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করলেও ডাকাতের হাত থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। ভিকটিমকে মুক্তি পেতে হয় মুক্তিপণের বিনিময়েই। আবার অনেকেই টাকা দিতে না পেরে ডাকাতের হাতে খুন হন।
গত ২ নভেম্বর ডাকাতের হাতে অপহরণের পর মুক্তিপণে ফেরত আসা করাচী পাড়ার বাসিন্দা কৃষক মো. আনোয়ার ইসলাম বলেন, গ্রামের পাশে পাহাড় সংলগ্ন ক্ষেতের জমিতে কৃষি কাজ করার সময় ডাকাত দল অস্ত্রের মুখে আমাকেসহ ৯ কৃষককে অপহরণ করে।
ডাকাতদল টাকার জন্য পাহাড়ে ভেতরে ব্যাপক নির্যাতন চালায়। পরে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে আমরা সবাই দুই দিন বন্দি থাকার পর ২ লাখ ৭৪ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত হই। তবে তারা এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অথবা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলতে নিষেধ করেছে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর হ্নীলা নাটমুড়া পাড়া এলাকার মো. আতিক উল্লাহ (৩০) নামের এক যুবক অপহরণের শিকার হন। এ ঘটনায় ডাকাত দল ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। পুলিশের তৎপরতায় তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পরে ৫ দিন বন্দি থাকার পর ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়েই বাড়িতে ফেরত আসেন অপহৃত আতিক উল্লাহ।
এর আগে ২০২৩ সালের ২৮ এপ্রিল তিন বন্ধু কক্সবাজারের ঈদগাঁওয়ের জালালাবাদ সওদাগর পাড়ার মো. ইউসুফ (৩০), চৌফলদণ্ডীর মো. রুবেল (২৮) এবং কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছড়ার মো. ইমরান (৩২) বেড়ানোর জন্য টেকনাফের বাহারছড়ায় গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ডাকাতদল তাদের অপহরণ করে।
পরে মুক্তিপণ হিসেবে ৩০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। দাবিমতো টাকা দিতে না পারলে ওই তিন বন্ধুকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার ২৫ দিন পরে দমদমিয়া পাহাড় থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের মরদেহ উদ্ধার করে বলে জানিয়েছেন নিহত মো. ইমরানের বাবা মো. ইব্রাহিম।
তিনি আরও বলেন, সেসময় তাদের উদ্ধারের জন্য টেকনাফ থানা পুলিশের দ্বারে দ্বারে যাওয়ার পরও জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
কক্সবাজার জেলা শাখার জামায়াতে ইসলামীর সভাপতি ও হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, অপহরণ বাণিজ্যসহ পাহাড়ি ডাকাত দলের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি।
পাহাড় সংলগ্ন এলাকার কৃষক-শ্রমিক ক্ষেতের জমিতে চাষাবাদসহ কাজের প্রয়োজনে সেখানে গেলে ডাকাত দলের ভয়ে তাদের আতঙ্কে থাকতে হয়। গত ২ নভেম্বর আমার গ্রামের ৭ কৃষক ও উনচিপ্রাং ক্যাম্পের ২ রোহিঙ্গা শ্রমিককে ডাকাতদল অপহরণ করেছিল। শুনেছি তারা মুক্তিপণ দিয়ে বাড়িতে ফেরত আসে।
এ বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমি টেকনাফ থানায় যোগদান করেছি বেশিদিন হয়নি। তবে সম্প্রতি কিছু অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার পর পুলিশের টিম অপহৃত ভিকটিমকে উদ্ধারে পাহাড়ে একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করে। পুলিশের অভিযানের তৎপরতায় অপহৃত ভিকটিমদের ডাকাতদল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। ডাকাত দলের এসব সদস্যদের আটক করতে পুলিশের টিম কাজ করে যাচ্ছে।
সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় বাঙালি কৃষক-শ্রমিক, টমটম (ইজিবাইক) ও সিএনজি চালক, শিক্ষার্থী, সাধারণ ব্যবসায়ী ও রোহিঙ্গাসহ ১৩৫ জন ব্যক্তি অপহরণের শিকার হয়েছিল। অধিকাংশ ব্যক্তি মুক্তিপণের বিনিময়ে ডাকাতের বন্দিশালা থেকে ফেরত এসেছিল।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ