রোহিঙ্গাদের অস্ত্র সংগ্রহ ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হুমকি দেওয়া এবং এর সঙ্গে গরুর পেট কেটে ভুঁড়ি বের করার একটি ছবি—২০১৭ সালের ১০ আগস্ট অন্তত ১০টি ফেসবুক পেজ থেকে ওই ছবিসহ খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভিন্ন নামে পরিচালিত ওই ফেসবুক পেজগুলো মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর। সেগুলো ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ভয় ও ঘৃণার বার্তা ছড়ানো হয়েছে।
রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের জনগণের ওপর সংঘটিত অপরাধের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণে জাতিসংঘ গঠিত মিয়ানমারবিষয়ক স্বাধীন তদন্ত কাঠামোর (আইআইএমএম) কাছে এ ধরনের লাখ লাখ তথ্য-প্রমাণ সরবরাহ করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক।
আইআইএমএমপ্রধান নিকোলাস কৌমজিয়ান গতকাল সোমবার দুপুরে জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় এ কথা জানান।
আইআইএমএমপ্রধান আরো জানান, এবারের বার্ষিক প্রতিবেদনে আইআইএমএম ২০০টিরও বেশি উৎস থেকে পাওয়া প্রায় ৩০ লাখ তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছে। এ সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। মানবাধিকার পরিষদে উপস্থাপনের জন্য কয়েক দিন আগে প্রতিবেদন তৈরির পর তাদের কাছে আরো দ্বিগুণের বেশি তথ্য এসেছে। সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এখন আইআইএমএমকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
নিকোলাস কৌমজিয়ান বলেন, আইআইএমএম আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে), আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিসি) ও অন্যান্য বিচারিক কর্তৃপক্ষকে সরবরাহের জন্য ৬৭টি তথ্য-প্রমাণ ও বিশ্লেষণের প্যাকেজ তৈরি করেছে। তদন্তের স্বার্থে মিয়ানমার সফরের জন্য যোগাযোগ করেও কোনো জবাব পাননি।
মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আইআইএমএমপ্রধান মানবাধিকার পরিষদকে জানান, সেখানে পরিস্থিতি আগের চেয়ে আরো জটিল হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ সৃষ্টির অপেক্ষায় আছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মিয়ানমারে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ আরো জোরালো হয়েছে। মা-বাবাকে খুঁজে না পেলে শিশুদের নির্যাতন ও বন্দি করা হচ্ছে।
প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনায় অংশ নেওয়া বেশির ভাগ দেশই রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারে বেসামরিক জনগণের ওপর নিপীড়নকারীদের বিচারের আওতায় আনার জোর তাগিদ দেয়। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থী কর্মীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নিন্দা জানায় তারা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জেনেভায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অপরাধ করে কেউ পার পাবে না—এটি নিশ্চিত করতে হবে। মিসরের রাষ্ট্রদূত রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলা এবং আইআইএমএমকে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান। ফ্রান্স কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই মানবিক সহায়তা কর্মীদের মিয়ানমারে প্রবেশের সুযোগ দাবি করেছে। লুক্সেমবার্গ মিয়ানমারে চলমান অপরাধের বিচার দাবি করেছে।
অস্ট্রেলিয়া রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছে। রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাপান। চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, এই আলোচনায় মিয়ানমার অংশ না নেওয়ায় চীন দুঃখিত। চীন আশা করে, জাতীয় স্থিতিশীলতা ও মিয়ানমারকে গুরুত্ব দিয়েই সমাধান হবে। তিনি আলোচনার মাধ্যমে মিয়ানমারকে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান।
যুক্তরাজ্য বলেছে, রাখাইনে এখনো ছয় লাখ রোহিঙ্গা আছে। তারা সব ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই এ বিষয়ে কাজ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত অপরাধের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহে যুক্তরাজ্য অর্থ সহায়তা দিচ্ছে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের নাগরিকদের ওপর সংঘটিত অপরাধের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহকে স্বাগত জানান। মিয়ানমার আইআইএমএমকে সহযোগিতা না করায় বাংলাদেশ দুঃখ প্রকাশ করেছে।
বেলজিয়াম বলেছে, সংকটের পাঁচ বছর পরও রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে থাকা দুঃখজনক। গাম্বিয়া বলেছে, তারা রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইসিজেতে মামলা এগিয়ে নিচ্ছে। ইতালি রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নকারীদের বিচারের আওতায় আনতে অঙ্গীকার তুলে ধরেছে।
ইরান রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। তুরস্ক রোহিঙ্গাদের জীবনমানের উন্নতির ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। কানাডা আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলার প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে।
আলোচনায় অংশ নেওয়া বেসরকারি সংস্থাগুলোও মিয়ানমারে সংঘটিত অপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছে।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ