বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যেও অধিক ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগ এখানে নিয়মিত ঘটনা। এতে অনেক কিছুর মতো ঝুঁকিতে পড়ছে সমুদ্রে থাকা দুটি ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ)।
তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বা রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্ধারিত এ স্টেশনের মাধ্যমে সমুদ্রে থাকা ট্যাঙ্কারগুলো থেকে এলএনজি কার্গো লোডিং ও আনলোড করা হয়। সেগুলোর কোনো একটি যখন অকেজো হয়, তখন চরম ভোগান্তিতে পড়ে পুরো দেশ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের টার্মিনালগুলোর কোনোটি ভাসমান আবার কোনোটি স্থলে। তবে বাংলাদেশে থাকা এলএনজি টার্মিলানের দুটিই ভাসমান। মূলত এই এলএনজি টার্মিনাল উপকূলের কাছে থাকা একটি বিশেষ জাহাজ। দুর্যোগপূর্ণ অবহাওয়ার পূর্বাভাস জানার পরে নিরাপদ রাখার জন্য এই এফএসআরইউ গভীর সমুদ্রে স্থানান্তর করা হয়।
জ্বালানি বিভাগের তথ্য বলছে, কক্সবাজারের মহেশখালীতে থাকা এই এফএসআরইউ দুটির একটি সামিট গ্রুপের, অন্যটি সিঙ্গাপুরভিত্তিক মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির। ২০১৮ সাল থেকে কোম্পানি দুটির সঙ্গে ১০ বছরের চুক্তি রয়েছে জ্বালানি বিভাগের। এর প্রতিটির ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৩৮ হাজার ঘনমিটার। এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশনে টার্মিনাল দুটির সক্ষমতা প্রতিদিন ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
টার্মিনাল দুটি একসঙ্গে চালু অবস্থায় প্রতিদিন গড়ে ৮০০ থেকে ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করে। দেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাস সরবরাহ এবং টার্মিনাল দুটি পূর্ণমাত্রায় চালু থাকার পরও জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের ঘাটতি থাকে। এর মধ্যে কোনো একটি টার্মিনাল বন্ধ হলে তীব্র গ্যাস সংকট দেশবাসীকে ভোগায়। বাসাবাড়িতে রান্নার বিড়ম্বনা থেকে শুরু করে কলকারখানার উৎপাদন কার্যক্রমও ব্যাহত হয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কারিগরি ত্রুটি বা অন্য কোনো কারণে বাংলাদেশে থাকা এফএসআরইউ দুটির কোনো না কোনোটি প্রায়ই বন্ধ থাকছে। সবশেষ ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামিট গ্রুপের এফএসআরইউ। এটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়েছে। এতে গ্যাস সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে।
এছাড়া টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর টার্মিনালের কারিগরি ত্রুটি দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালটি রক্ষণাবেক্ষণে যায়। সে সময়ও দেশজুড়ে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই ল্যান্ডবেজড বা ভূমিতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে। এফএসআরইউ একটি অস্থায়ী সমাধান। এটি কখনো দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই হতে পারে না।
পেট্রোবাংলা বলছে, সামিটের এলএনজি টার্মিনালটি বন্ধ থাকায় এখন এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনাল দিয়ে প্রতিদিন মাত্র ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আরও দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রতিদিন পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিদিন চাহিদা রয়েছে ৩১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের। এতে প্রতিদিনই প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকছে।
তারা আরও বলেন, ৬ বা ৭ জুলাই সামিটের এফএসআরইউ সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। ১২ জুলাই এটি দেশে পৌঁছাবে। দেশে পৌঁছানোর পর কার্যক্রম শুরু করতে আরও তিনদিন লাগবে। ফলে ১৫ থেকে ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে এটি গ্যাস সরবরাহ শুরু করবে। সমস্যাও সে পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
এসব নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক, জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, আমাদের দিন আনি দিন খাই অবস্থা। আমাদের তো এফএসআরইউ করার কথাই ছিল না। যখন দেখা যায় যে হাতে সময় নেই, তখন এফএসআরইউ করে। এটি ল্যান্ডবেজড করতে হবে।
এখন আমরা দুটি এফএসআরইউ করে এগুলোর ওপরে নির্ভরশীল হয়ে আছি। এভাবে হয় না। আমাদের সময়ের কোনো অসুবিধা ছিল না। আমরা ২০১৫ সাল থেকে এগুলো করছি, প্রায় দশ বছর হয়ে গেছে।
এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, একটা গ্যাপ হয়েছিল, সেটা পূরণ করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেভাবেই চলছে। কিন্তু সেটা কারেক্ট করার জন্য উদ্যোগ নেই। এফএসআরইউ দুটার বদলে একটা ল্যান্ডবেজড করার দরকার ছিল।
দেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধানে যে অর্থ লাগবে সেই অর্থ এই বাজেটে বরাদ্দ নেই। এখন জনগণকে বুঝ দেওয়ার জন্য অনেক কিছুই বলা হচ্ছে। আমাদের অনেক বেশি গ্যাস অনুসন্ধানের দিকে নজর দিতে হবে।
তাহলে দুটি জিনিস হবে। আমরা কিছু না কিছু গ্যাস পাবো। যতটুকু গ্যাস আমরা পাবো তাতে খরচ উঠে যাবে। অতিরিক্ত গ্যাস পাওয়ার একটা চান্স থাকবে। যদি নাও পাই, তাহলে আমরা বুঝতে পারবো আমাদের আর কোনো গ্যাস নেই, অন্যভাবে ম্যানেজ করি। কিন্তু সরকার এটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না।
এসব নিয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ল্যান্ডবেজড পরিকল্পনা আমাদের ২০১৭ সাল থেকে ছিল। এটি মাতারবাড়িতে হবে। তবে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এখনো সেই চ্যানেল তৈরি করেনি।
তাদের চ্যানেল তৈরির পরিকল্পনা ২০৩০ বা ২০৩১ সালে। আমরা বলেছি ২০২৭ বা ২০২৮ সালের মধ্যে এই চ্যানেল তৈরি করে দিতে হবে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যদি ২০২৯ সালের মধ্যে চ্যানেল তৈরি করতে পারে তাহলে আমরা কন্ট্রাক্ট করতে পারি।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আরও বলেন, পায়রায় এই টার্মিনালের পরিকল্পনা রয়েছে। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে তারা ২০২৯ সালের মধ্যে ১৫ মিটারের ওপরে ড্রাফট তৈরি করবে। পায়রা নিয়েও আমরা কাজ শুরু করেছি। পায়রা এবং মাতারবাড়ি, যেটি আগে হয় (সেটিতে) আমরা ল্যান্ডবেজড টার্মিনাল নির্মাণের জন্য প্রতি মুহূর্তে কাজ করছি। তবে এটি শুধু আমাদের একার সিদ্ধান্ত নয়। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বন্দর কর্তৃপক্ষ কবে ড্রাইভ তৈরি করবে সে অনুযায়ী আমরা কাজ করবো।
তিনি বলেন, আমরা টিম গঠন করে কাজ করছি। যদি পায়রায় ২০২৯ সালের মধ্যে ১৫ মিটারের বেশি ড্রাফট পেয়ে যাই তাহলে এখানে অগ্রসর হবো। আর মহেশখালীতে ভাসমান তৃতীয় টার্মিনালের জন্য সামিটের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এটি ২০২৬ সালের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে চলে আসবে।
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ