ভারত থেকে ৫০ হাজার টাকায় কেনা অবৈধ অস্ত্র নিয়ে সীমান্তের নিরাপত্তা বাহিনীর নজর এড়িয়ে ঢুকতো বাংলাদেশে। দেশে এনে সেগুলো বিক্রি করতো ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকায়, অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ দামে। এসব অস্ত্র বাংলাদেশে বিভিন্ন সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির কাজে ব্যবহোর হতো। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত এভাবেই দুই শতাধিক অবৈধ অস্ত্র ভারত থেকে বাংলাদেশে এনে বিক্রি করেছে আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাকারবারি দলের সদস্যরা।
এমনই একটি চক্রের পাঁচ অস্ত্র চোরাকারবারিকে বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) রাতে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগ। রাজধানীর মিরপুর, দারুস সালাম ও গাবতলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে আটটি বিদেশি পিস্তল, আট রাউন্ড গুলি, ১৬টি ম্যাগাজিন ও একটি প্রাইভেটকার জব্দ করে ডিবি।
গ্রেফতার পাঁচজন হলেন- আকুল হোসেন, ইলিয়াস হোসেন, আব্দুল আজিম, ফারুক হোসেন ও ফজলুর রহমান। তারা সবাই যশোরের বেনাপোল ও শার্শা থানা এলাকার বাসিন্দা।
বৃহস্পতিবার (২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে তাদের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত তুলে ধরেন ডিবিপ্রধান অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার।
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি ডিবির গুলশান বিভাগ বিভিন্ন অপরাধীর কাছ থেকে বেশ কয়েকটি অবৈধ অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলো তদন্তকালে জানা যায়, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসায়ীর একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা যশোরের বেনাপোল থেকে অস্ত্র ও গুলি সংগ্রহ করে। এছাড়া তারা দেশে অপরাধীদের কাছে অস্ত্র-গুলি সরবরাহ করছে। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়ে বেনাপোল এলাকার কে বা কারা এসব অবৈধ অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তা তদন্তে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়।’
‘তদন্তের এক পর্যায়ে গোয়েন্দা তথ্য ও তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে গোয়েন্দা (গুলশান) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমানের নেতৃত্বে বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) গভীর রাতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। আন্তর্জাতিক অস্ত্র বেচা-কেনা দলের সদস্যরা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি নিয়ে অপরাধীদের কাছে বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রাইভেটকারযোগে গাবতলী বাসস্ট্যান্ড হয়ে ঢাকায় ঢুকবে- এমন সংবাদের ভিত্তিতে ডিবি গুলশান বিভাগের তিনটি টিম দারুসসালাম থানা এলাকার দিয়াবাড়ীগামী রাস্তা, বেড়িবাঁধগামী রাস্তা ও কল্যাণপুরগামী রাস্তায় ওঁৎ পেতে থাকে।’
হাফিজ আক্তার জানান, এরপর রাত আনুমানিক সোয়া ৩টার দিকে গাবতলী ব্রিজের ইউলুপ দিয়ে সন্দেহজনকভাবে একটি সিলভার রংয়ের প্রাইভেটকার দ্রুতগতিতে উত্তর দিকে অগ্রসর হলে দিয়াবাড়ী টিমকে রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে বলা হয়। এসময় অন্য টিমগুলোও প্রাইভেটকারটির পেছনে ধাওয়া করে। ডিবি সদস্যরা স্থানীয়দের সহায়তায় রাস্তায় চলাচলরত গাড়ি দিয়ে দারুস সালাম থানাধীন বেড়িবাঁধ বড় বাজারস্থ আক্তার হাজীর মাংসের দোকানের সামনে পাকা রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করে।
ডিবি প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার জানান, জ্যামে আটকা পড়া গাড়িটিকে ডিবি পুলিশের সদস্যরা স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় ঘিরে ফেললে প্রাইভেটকারটির চালক ও পেছনের সিটের একজন লাফিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তখন তাদের ধরে ফেলা হয়। ডিবির অপর সদস্যরা স্থানীয় লোকদের সহযোগিতায় গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে গাড়িতে অবস্থানরত অপর তিনজনকে ধরে ফেলেন।
এসময় তাদের তল্লাশি করে আকুল হোসেনের কোমরের পেছনে প্যান্টে গোঁজা অবস্থায় এক রাউন্ড গুলিভর্তি একটি বিদেশি পিস্তল ও গলায় ঝুলিয়ে রাখা একটি হ্যান্ডব্যাগে পাঁচটি বিদেশি পিস্তল, পাঁচ রাউন্ড গুলি, আটটি খালি ম্যাগাজিন; আব্দুল আজিমের কোমরের পেছনে গোঁজা অবস্থায় এক রাউন্ড গুলিসহ একটি বিদেশি পিস্তল; ইলিয়াস হোসেনের কোমরের পেছনে প্যান্টে গোঁজা অবস্থায় এক রাউন্ড গুলিসহ একটি বিদেশি পিস্তল; অবৈধ অস্ত্র বেচা-কেনার সহযোগী মিলন হোসেন এবং গাড়িচালক ফজলুর রহমানকে একটি প্রাইভেটকারসহ গ্রেফতার করা হয়।
এ কে এম হাফিজ আক্তার জানান, গোয়েন্দা (গুলশান) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমানের নির্দেশনায় অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. কামরুজ্জামান সরদারের তত্ত্বাবধানে এডিসি মাহবুবুল হক সজীবের নেতৃত্বে অভিযানটি পরিচালিত হয়।
গ্রেফতার ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে ডিবি প্রধান বলেন, ‘চক্রটির মূলহোতা আকুল নিজে বা তার বিশ্বস্ত লোকজনের মাধ্যমে বেনাপোল সীমান্ত এলাকা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে যশোর, খুলনা, বাগেরহাট ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সেগুলো সরবরাহ করছিলেন। আকুল ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত দুই শতাধিক অবৈধ অস্ত্র নিজে বিক্রি করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘অস্ত্র চোরাচালানসহ চক্রের সদস্যরা তক্ষক প্রতারণা, সীমান্ত পিলার, সাপের বিষ, গোল্ড স্মাগলিং, প্রত্নতাত্ত্বিক মূর্তি, ইয়াবা ও আইস-মাদক কারবারেও জড়িত ছিলো।’
ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, ‘চক্রটি ভারত থেকে ৫০ হাজার টাকায় কেনা অস্ত্র বাংলাদেশে এনে বিক্রি করতো ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকায়। এসব অস্ত্র ভারত থেকে সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে আনা হতো। যেগুলো দিয়ে দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। বিশেষ করে চাঁদাবাজির জন্য এসব অস্ত্র কেনা হতো বলে জানিয়েছেন চক্রের সদস্যরা।’
সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, ‘ভারতে তৈরি এসব অবৈধ অস্ত্র ২৮ থেকে ৫০ হাজার টাকায় কিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন পার্টির কাছে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি করতো চক্রের লোকেরা।’
বাংলা৭১নিউজ/এসএইচ