বাংলা৭১নিউজ, ডেস্ক: ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের পরামর্শ মেনে নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট মঙ্গলবার রায় দিয়েছে যে সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর প্রথা আর বাধ্যতামূলক থাকবে না।
এর আগে ২০১৬তে দেশের শীর্ষ আদালতই বলেছিল যে দেশের প্রতিটি সিনেমা হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের আগে জাতীয় সঙ্গীত বাজাতেই হবে – এবং তখন দর্শকদের উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতে হবে।
কিন্তু সেই নির্দেশ নিয়ে দেশব্যাপী বিতর্কের পর সরকার আপাতত তা প্রত্যাহার করে নিতে আদালতকে অনুরোধ জানায়।
আজকের রায়ের পর বিরোধী নেতারা বলছেন, বিজেপি সরকার দেশে যে উগ্র জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা নিয়ে চলছে তা বড় ধাক্কা খেল – যদিও শাসক দল সে কথা মানতে প্রস্তুত নয়।
বছরদেড়েক আগে সুপ্রিম কোর্ট যখন সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো বাধ্যতামূলক করেছিল, তারপর ভারতের নানা প্রান্তে এই রীতি নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে।
কোথাও দর্শকরা কেউ কেউ উঠে না-দাঁড়ানোয় হলের বাকিরা তাদের হেনস্থা করেছেন, শারীরিক প্রতিবন্ধীরাও বাদ যাননি। কোথাও আবার জাতীয় সঙ্গীত শুরু হতেই লোকজন হল থেকে বেরিয়ে গেছেন।
আজকের রায়ের পর সেই সব অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক বা জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা বন্ধ হবে বলেই আবেদনকারীরা আশা করছেন।
পিটিশনারের আইনজীবী অভিনব শ্রীবাস্তব বলছেন, “এই রায়ে আমাদের আংশিক জয় হয়েছে অবশ্যই – কারণ আমরা বলেছিলাম জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা বলতে কী বোঝায় আর কীভাবে তা দেখানো যায় সে বিষয়ে স্পষ্টতা দরকার।”
“আগে যেটা বাধ্যতামূলক ছিল, আজকের পর সেটা আর তা থাকছে না – কিন্তু এটাও বলা হয়েছে যদি জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয় তাহলে দর্শকদের অবশ্যই উঠে দাঁড়াতে হবে। একমাত্র প্রতিবন্ধীরা তা থেকে ছাড় পাবেন।”
এদিকে গত মাসেই ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি দশ সদস্যের আন্ত:মন্ত্রণালয় কমিটি গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে – কীভাবে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা সুনিশ্চিত করা সম্ভব সে বিষয়ে আগামী ছমাসের মধ্যে এই কমিটি তাদের সুপারিশ জানাবে।
এই কমিটির মতামত না-আসা পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট তাদের আগেকার নির্দেশ মুলতুবি রাখুক, হলফনামা পেশ করে সেই আর্জিই জানিয়েছিল সরকার এবং এদিন শীর্ষ আদালত তা মেনে নিয়েছে।
তবে আসাদউদ্দিন ওয়াইসির মতো ভারতের বিরোধী নেতারা মনে করছেন, বিজেপির জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার জন্য এটা একটা বড় আঘাত।
মি ওয়াইসি বলছেন, “থিয়েটার হলে কেন খামোখা জাতীয় সঙ্গীত বাজাতে হবে? আমি তাই মনে করি সুপ্রিম কোর্ট সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে, আমি একে স্বাগত জানাই। আসলে বিজেপি যেভাবে সব জিনিসে জাতীয়তাবাদ জুড়ে দিতে চায় – তাও আবার হিন্দু জাতীয়তাবাদ – সুপ্রিম কোর্ট সেটাতেই লাগাম পড়িয়ে দিয়েছে।”
“আমাদের বুঝতে হবে স্বাধীনতা দিবস-প্রজাতন্ত্র দিবসে কিংবা সরকারি অনুষ্ঠানে, অথবা অলিম্পিক-বিশ্বকাপের আসরে দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো চলে এবং বাজানো উচিতও, কিন্তু যেখানে-সেখানে বাজালে এর মর্যাদাই খাটো হয়।”
বস্তুত জাতীয় সঙ্গীতের সম্মান করা বিজেপির ঘোষিত রাজনৈতিক লক্ষ্যর মধ্যেই পড়ে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই নীতির সঙ্গে কোনও ধরনের আপস করা হয়েছে বলে মানতে প্রস্তুত নন দলের কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিনহা।
তিনি বলছিলেন, “দেখা যাচ্ছে সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময় অনেকেই বেরিয়ে চলে যাচ্ছেন। আসলে আগে দেশে জাতীয়তাবোধ তৈরি করা দরকার। আমাদের দেশে এই বোধটার খুবই অভাব আছে, বিশেষ করে বিরোধী দলের বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে! এই বোধটা তৈরি হলে আপনা থেকেই লোকে জাতীয় সঙ্গীতকে সম্মান জানাবে, আইন করে সেটাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে না।”
“মুশকিল হল জাতীয়তাবোধের চেতনাটা জোর করে কাউকে শেখানো যায় না, আইন করেও কোনও লাভ হয় না। আমরা বিশ্বাস করি ধীরে ধীরে এই বোধটা মানুষের মধ্যে জাগরূক হবে – আর তখন সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজলে মানুষ আপনা থেকেই উঠে দাঁড়াবে, আর বাজানো শেষ না-হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়েই থাকবে!”
বস্তুত বিবিসিকে দেওয়া এই বক্তব্যে মি সিনহা মেনেই নিচ্ছেন, তারা যে ধরনের জাতীয়তাবাদী চেহারায় দেশবাসীকে দেখতে চান – ভারত এখনও তার জন্য আদৌ প্রস্তুত নয়।
আর সেই বাস্তবতা থেকেই যে সিনেমা হলে বাধ্যতামূলকভাবে জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর প্রশ্নে সরকার ও সুপ্রিম কোর্টকে এখনকার মতো পিছু হঠতে হল, তাতেও কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। সূত্র: বিবিসি
বাংলা৭১নিউজ/বিবিএস