বাংলা৭১নিউজ ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল ভারত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি সে আশায় গুঁড়ে বালি দিয়েছে।
উপরন্তু চীনের আগ্রাসী উন্নয়ন নীতি ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে এমন এক উচ্চতায় যেখান থেকে দেশটি পিছিয়ে পড়ছে। ফলে আবার পুরনো পথে ফেরার চেষ্টা।
নতুন ভরসা পুরনো মিত্র রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ঝালিয়ে তোলা। এর অংশ হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন।
পাকিস্তানের সাথে চীন ও রাশিয়ার সম্পর্কের গতি ভারতকে বাধ্য করছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে। ভারত দেখতে পাচ্ছে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে চৈনিক মিত্রতা কি সুগভীর হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার পাত্তাই দিচ্ছে না ভারতকে, পাকিস্তান তো নয়ই। তাই অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক রাশিয়ার সাথে বৃদ্ধি করার কোনো আপাতত বিকল্প নেই ভারতের কাছে। রাশিয়ার সাথে ঠাণ্ডা যুদ্ধের আগের সম্পর্ক ফিরে পেতে চায় ভারত।
চীনের সাথে সিল্ক রুটে যোগ না দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে রেখে যে ভুল করেছে ভারত তা শোধরাতেই রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়া সফরের পর দুই দেশের মধ্যে এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কমপ্লেক্স নির্মাণে চুক্তি হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকার।
রাশিয়ার ওপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতা থেকে এই চুক্তিকে মুক্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। আগামী অক্টোবরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের বার্ষিক সম্মেলনেই চুক্তিটির পূর্ণাঙ্গ ঘোষণা দেয়া হবে। দিল্লি এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চীনের সাথে তাদের সীমান্ত ঘেঁষে মোতায়েনের পরিকল্পনা করেছে।
রাশিয়া বঙ্গোপসাগরে বড় ধরনের নৌ সামরিক শক্তি হিসেবে মিয়ানমারকে সাহায্য করার পাশাপাশি চীনের ধীরগতির সামরিক সহায়তা পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এমনকি মালদ্বীপেও বাড়ছে।
এর পাশাপাশি পাকিস্তানের নৌশক্তির চার পাশে ভারত পাল্টা নৌশক্তি গড়ে তুলছে। গত বছর ভারত পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন থেকে ব্যালেস্টিক মিসাইল ছোড়ার পর এখন দেশটি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে কিভাবে এ অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে।
কারণ পাকিস্তানও এরই মধ্যে সাবমেরিন থেকে ক্রুজ মিসাইল ছুড়ে পরীক্ষা করেছে, যা পারমাণবিক শক্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতাকে এ অঞ্চলে আরো ত্বরান্বিত করবে।
এ দিকে রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার পর ২০২৫ সালে তা ৩০ বিলিয়নে উন্নীত করতে গত মার্চে দুই দেশের মন্ত্রীরা সব ধরনের বাধা অপসারণ করতে একমত হন।
রাশিয়ার সহায়তায় ইউরাশিয়ান ইকোনোমিক ইউনিয়নেও ভূমিকা রাখতে চায় ভারত। জাহাজ নির্মাণ, জ্বালানি, এভিয়েশন, ইলেক্ট্রোনিকস, ভারী শিল্প, ওষুধ ও কম্পিউটার শিল্প নিয়ে এ দু’টি দেশের আন্তঃসরকার কমিশন ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করেছে।
দু’টি দেশের মধ্যে স্থল সীমান্ত না থাকায় ৮০ শতাংশ পণ্য সেন্টপিটার্সবার্গ থেকে সুয়েজখাল হয়ে নৌপথে আনতে হয়। এ জন্য রাশিয়া, ভারত, ইরান ও আজারবাইজান একটি বিকল্প রুট ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট করিডোর’ তৈরিতে কাজ করছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে রেলপথের মাধ্যমে এ করিডোরে সংযুক্ত করলে ভারত বিকল্প একটি বাণিজ্য রুট পাবে। যা রাশিয়ার সাথে ভারতের নৌপথের ওপর নির্ভরশীলতা বেশ কিছুটা কমাবে।
ভারত মহাসাগর বা দক্ষিণ চীন সাগর ছাড়াও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর, আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরে চীনের সরব সামরিক উপস্থিতি ভারতকে রাশিয়ার দিকে আরো ঝুঁকতে এক ধরনের তাড়া করেছে।
যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়ার সাথে সম্পর্ককে বিশেষ ও কৌশলগত বলছেন, একই সাথে রাশিয়া ভারতের চিরশত্রু হিসেবে বিবেচিত পাকিস্তানের সাথে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের যে অবরোধ রয়েছে রাশিয়া ও ইরানের ওপর সেখানে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ভারত চাইছে সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে। সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের সদস্য হতে রাশিয়ার সহযোগিতা চেয়েছে ভারত, যা পেলে ইউরাশিয়ান রাজনীতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তায় ভারত সম্পৃক্ত হয়ে তার পররাষ্ট্রনীতিকে আরো ক্ষুরধার করে তুলবে। গত পাঁচ বছরে ভারত তার ৬২ শতাংশ অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করেছে রাশিয়া থেকে।
যদিও গত দেড় দশকে ভারতের সাথে রাশিয়ার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের পরিধি বেড়েছে। ২০০৪ সালে মনমোহন সিংয়ের উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
কিন্তু এখন উল্টোরথে চলতে চাচ্ছে ভারত। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র ক্রয়, ভারতীয় কর্মকর্তাদের দেশটি সফর, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি, সফটওয়্যার ক্ষমতা, যৌথ সামরিক মহড়ায় এতদিন প্রিয় অংশীদার বলেই মনে হতো ভারতকে।
কিন্তু ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট নীতি’ এ সম্পর্কে ছেদ টেনেছে। যতটা আশা করা হয়েছিল ততটা কাক্সিক্ষত মার্কিন বিনিয়োগ ভারতে আসেনি।
রাশিয়ার সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্কে ভারত কিছুটা পিছিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে বেশি ঝুঁকেছিলেন। এখন প্রায়শ্চিত্য শুরু করেছে ভারত। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কমিয়ে এনে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও কাজাখাস্তান ছাড়াও মধ্য এশিয়ার আরো দু’টি দেশের সাথে যে নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাচ্ছে।
তাতে ইরান ও রাশিয়াকে কাছে চান নরেন্দ্র মোদি। পাকিস্তানের সাথে রাশিয়ার যৌথ সামরিক মহড়ার সিদ্ধান্তে ভারতের টনক নড়ে গেছে। কারণ চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া থেকে অস্ত্র সংগ্রহের পর পাকিস্তান তা যদি সম্মিলিতভাবে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযোগ পায় তা মোকাবেলার উপযুক্ত সময় এখন। ফলে উল্টোপথে চলা বা পুরনো মিত্রকে নতুন করে আঁকড়ে ধরা ছাড়া ভারতের কোনো পথ খোলা নেই। সূত্র : এরাবিয়ান জার্নাল।
বাংলা৭১নিউজ/জেএস