ভারতের আগ্রাসী দৃষ্টি গ্রাস করে নিয়েছিল সিকিমের মত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে। ভারতের পার্শ্ববর্তী কোন দেশই এমন ঘটনার পর থেকে ভারতে আর বিশ্বাস করেনা। ১৯৭৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিকিম আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের ২২তম রাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক সুধীর শর্মা নেপালের কান্তিপুর পত্রিকায় ‘পেইন অব লুজিং এ নেশন‘ (একটি জাতির হারিয়ে যাওয়ার বেদনা) নামে ২০০৭ সালের একটি প্রতিবেদনে জানান, ‘ভারত তার স্বাধীনতার গোড়া থেকেই সিকিম দখলের পরিকল্পনা করেছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু অনেকের সাথে কথোপকথনে তার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন।’
সুধীর শর্মা লিখেন, ‘লেন্দুপ দর্জি নিজেই তাকে বলেছেন, ‘ভারতের ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর লোকেরা বছরে দু’তিনবার তার সাথে দেখা করে পরামর্শ দিত কিভাবে আন্দোলন পরিচালনা করা যাবে। তাদের একজন এজেন্ট তেজপাল সেন ব্যক্তিগতভাবে তাকে অর্থ দিয়ে যেতো এ আন্দোলন পরিচালনার জন্য। এ অর্থ দিয়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাস পরিচালিত হতো।’
সিকিমকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের ২২তম রাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তি আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। এটি ছিল একটি দীর্ঘ কূটনৈতিক ও সামরিক প্রক্রিয়ার ফল, যার মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাজ্য তার সার্বভৌমত্ব হারায়। ভারতের কৌশলগত পরিকল্পনা, সিকিমের অভ্যন্তরীণ সংকট এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি মিলে সিকিমের স্বাধীনতার পরিসমাপ্তি ঘটায়।
হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত ছোট্ট রাজ্য সিকিম ব্রিটিশ শাসনামলেও নিজেদের সীমিত স্বাধীনতা বজায় রেখেছিল। ১৮১৪ সালের ব্রিটিশ-নেপাল যুদ্ধের পর এটি ব্রিটিশ প্রভাবাধীন হয়ে ওঠে, যদিও শাসনব্যবস্থা স্বাধীন ছিল।
ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৭ সালে সিকিমের জনগণ ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানিয়ে স্বাধীনতা বজায় রাখে। তবে, ১৯৫০ সালে সিকিম ভারতের আশ্রিত রাজ্য হয়ে যায়, যার ফলে সিকিমের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা ভারতের নিয়ন্ত্রণে আসে।
স্বাধীনতার পর থেকেই সিকিম অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভুগছিল। রাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের প্রশ্নে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। ভারতের প্রভাব বাড়তে থাকে।
সত্তরের দশক থেকেই নেহেরু-প্রভাবিত কাজী লেন্দুপ দর্জি তার দল সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেসকে ব্যবহার করে ব্যপক অরাজকতা সৃষ্টি করেন। রাজপ্রাসাদের সামনে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে ইন্দিরা সরকার রাজার নিরাপত্তার কথা বলে ভারতীয় বাহিনী পাঠায়। কিন্তু তারা মূলত রাজাকে গৃহবন্দী করেন, বহির্বিশ্বের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং বি এস দাশকে ভারত সরকার সিকিমের প্রধান প্রশাসক নিয়োগ করে।
১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতের কাছে সিকিম কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা এবং সেনাবাহিনী সিকিমের অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িক বিভেদকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ায়। বৌদ্ধ রাজপরিবার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপালি হিন্দু জনগণের মধ্যে বিভেদকে ভারত তাদের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে।
এর মধ্যে ভারতের তাঁবেদার লেন্দুপ দর্জির নেতৃত্বাধীন সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস (এসএনসি) ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পার্লামেন্টের ৩২ আসনের মধ্যে ৩১টি আসনে জয়লাভ করে। নির্বাচনে জিতে ১৯৭৫ সালের ২৭ মার্চ প্রথম ক্যাবিনেট মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জি রাজতন্ত্র বিলোপ ও জনমত যাচাইয়ে গণভোটের সিদ্ধান্ত নেন। ততদিনে সিকিমে ভারতীয় সেনাবাহিনী ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে। তারা বন্দুকের মুখে ভোটারদের ‘হ্যাঁ’ভোট দিতে বাধ্য করে। মূলতঃ পুরো ঘটনাই ছিল সাজানো।
৬ এপ্রিল ১৯৭৫ সালের সকালে সিকিমের রাজা যখন নাস্তা করতে ব্যস্ত সে সময় ভারতীয় সৈন্যরা রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে এবং রাজাকে বন্দী করে প্রাসাদ দখল করে নেয়। ২৬ এপ্রিল সিকিমকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের ২২তম রাজ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সিকিম সেনাবাহিনীকে সহায়তা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। তারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে গ্রাস করে ভারতের প্রদেশে পরিণত করে।
সাংবাদিক ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারত অনেক আগেই সিকিম দখলের পরিকল্পনা করেছিল। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সাবেক পরিচালক অশোক রায়না তার বই ‘ইনসাইড র’ -এ উল্লেখ করেন, ‘সিকিম দখলের জন্য ভারত কৌশলগত পরিস্থিতি তৈরি করতে আন্দোলন, সন্ত্রাস, এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদকে ব্যবহার করেছে। সিকিমের রাজতন্ত্রবিরোধী নেতা লেন্দুপ দর্জি ভারতীয় সংস্থাগুলোর সহায়তায় এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন।’
সাংবাদিক সুধীর শর্মা আরও লিখেছেন, এই ‘সিকিম মিশনে’র প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা, যা সর্বত্র ‘র’ নামে পরিচিত।
সিকিমের চোগিয়ালের তৎকালীন এডিসি ক্যাপ্টেন সোনাম ইয়াংজু লিখেছেন, ‘ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বেসামরিক পোশাকে রাজার বিরুদ্ধে গ্যাংটকের রাস্তায় মিছিল, আন্দোলন ও সন্ত্রাস করত। নেহেরুর পরামর্শ, মদদ ও উৎসাহে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠন করেছিলেন লেন্দুপ দর্জি। শ্লোগান তুলেছিলেন, ‘গণতন্ত্রের সংগ্রাম চলছে, চলবে’।’
লেন্দুপ দর্জির গণতন্ত্রের শ্লোগান শুনে সিকিমের সাধারণ জনগণ ভাবতেই পারেনি, এই শ্লোগানের পিছনে প্রতিবেশী দেশ একটি জাতির স্বাধীনতা হরণ করতে আসছে। সিকিমের জনগণকে দ্বিধাবিভক্ত করে ভারত তার আগ্রাসন সফল করতে এবং এক পক্ষকে ক্ষমতায় এনে তাদের দ্বারা দেশ বিক্রির প্রস্তাব তুলে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছিল।
সিকিমের স্বাধীনতা হারানোর গল্প কেবল রাজনৈতিক এবং সামরিক চক্রান্তের ফল নয়, বরং এটি একটি স্বাধীন জাতির অভ্যন্তরীণ বিভেদের সুযোগ নিয়ে সার্বভৌমত্ব হারানোর করুণ অধ্যায়। আজ সিকিম ভারতের একটি পর্যটন গন্তব্য হিসেবে পরিচিত, কিন্তু তার হারানো স্বাধীনতার গল্প ইতিহাসের পাতায় এক লজ্জাজনক অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে।
বাংলা৭১নিউজ/এসকে