মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট, সংক্ষেপে এমএসজি আমাদের কাছে এটি ‘টেস্টিং-সল্ট’ নামেই বেশি পরিচিত। খাবারকে সুস্বাদু করার জন্য, প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন- পিজ্জা, স্যান্ডউইচ, স্যুপ, চানাচুর, ক্র্যাকারস, সলটেড, ভেজিটেবল, বিস্কুট, নুডলস, সস, চিপস, ফাস্টফুড এবং প্রধানত চাইনিজসহ হোটেলের খাবার মজাদার-মুখরোচক করতে এটি ব্যবহার করা হয়। গবেষকদের মতে, দীর্ঘসময় টেস্টিং সল্ট ব্যবহারকারীদের মস্তিষ্কে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
কৃত্রিম স্বাদ বৃদ্ধিকারী টেস্টিং-সল্ট নিয়ে বিশ্বব্যাপী একাধিক গবেষণার পর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ এক ভয়ানক নীরব ঘাতক। গবেষকদের মতে, টেস্টিং-সল্ট নানাভাবে মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন করে। বিভিন্ন গবেষণা-প্রতিবেদনে তাই একে অভিহিত করা হয়েছে ‘স্নায়ু বিষ’ হিসেবে। শিশুদের জন্যে এটি আরো মারাত্মক। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, টেস্টিং-সল্টের প্রতিক্রিয়ায় তীব্র মাথাব্যথা, হজমযন্ত্রের গোলযোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, খিঁচুনিসহ বিভিন্ন রকম সমস্যা এমনকি দীর্ঘ মেয়াদে মস্তিষ্কের ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। একটি গবেষণা-প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেস্টিং-সল্টের আগ্রাসন বিশ্বজুড়ে এলকোহল ও নিকোটিনের চেয়েও বড় বিপদ ঘটাতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কয়েক বছর আগে স্নায়বিক অসুস্থতার লক্ষণযুক্ত নতুন রোগের কথা জানায়, যার নাম দেওয়া হয় ‘চায়নিজ রেস্টুরেন্ট সিনড্রোম’। বিজ্ঞানীরা একে উদ্দীপক বিষ নামে অভিহিত করেছেন। টেস্টিং সল্ট মানবদেহে প্রবেশ করে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে বিষিয়ে তোলে। ফলে স্নায়ুতন্ত্র সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, কাজে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়, ঘুম কম হয়, স্বাভাবিক খাবার অরুচিকর লাগে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘নিয়মিত টেস্টিং সল্ট ব্যবহারকারীদের মধ্যে মাথাব্যথা, খিঁচুনি, হরমোন নিঃসরণে গোলযোগ, মনোবৈকল্য, শিশুদের ক্ষেত্রে লেখাপড়ায় কম মনোযোগ. অতিরিক্ত ছটফটানি ভাব, হঠাৎ ক্ষেপে যাওয়া, মুটিয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে। অ্যাজমায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা টেস্টিং সল্ট খেলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এ ছাড়া এটি মস্তিস্কে ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। বিশ্বের কয়েকটি দেশে টেস্টিং সল্ট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও এটি নিষিদ্ধ করা উচিত।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট বা টেস্টিং সল্ট মানবদেহে অতি সামান্য মাত্রায় কোষ-বহিঃস্থ তরল হিসেবে থাকে। টেস্টিং সল্ট খাওয়ার কারণে কোষ-বহিঃস্থ্থ তরলে ট্রান্সমিটারের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে নিউরনগুলো উদ্দীপ্ত করে। নিউরনের কাজ হলো বৈদ্যুতিক আবেশ ফায়ার করা। অতিরিক্ত উদ্দীপ্ত হওয়ার কারণে নিউরনগুলো অতিরিক্ত পরিমাণে ফায়ার করতে থাকে, যার বিলম্বিত প্রতিক্রিয়ায় একসময় কোষগুলোর মৃত্যু হয়। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে এক্সাইটোটক্সিনের প্রতিক্রিয়াগুলো লক্ষণীয় হতে দীর্ঘদিন সময় লাগে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মনোসোডিয়াম গ্লুটামেটের প্রতিক্রিয়া রোধে ভিটামিস ‘সি’খাওয়া যেতে পারে। গ্লুটামেট ব্যবহারে যে শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, ভিটামিন সি গ্রহণের মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করা যায়।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর’র সাবেক পরিচালক ও বর্তমান স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘টেস্টিং সল্টের বিষয়ে এখনও দেশে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। এটি মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই আইইডিসিআর টেস্টিং সল্ট ব্যবহার না করার জন্য জনসাধারণকে অনেক আগে থেকেই সচেতন করে আসছে। তবে এই সল্টের ব্যবহার বন্ধ করতে তেমন জোরালো কর্মসূচি এখনো গৃহীত হয়নি।’
পৃথিবীর অনেক দেশেই খাদ্যপণ্যে টেস্টিং-সল্টের ব্যবহার সরকারি আদেশে নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত। তাই কিছু বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে যারা সেসব দেশে তাদের পণ্যে টেস্টিং-সল্ট ব্যবহার করতে না পারলেও আইনের সুযোগ নিয়ে আমাদের দেশে অনায়াসেই টেস্টিং-সল্টযুক্ত খাবার বাজারজাত করছে। কিন্তু ভারতে পণ্যের মোড়কে উল্লেখ থাকে-‘নো এডেড এমএসজি’ অর্থাৎ এটি টেস্টিং-সল্টমুক্ত।
পণ্যের মান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই-এর একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘টেস্টিং সল্ট আমদানির বিষয়ে সরকারিভাবে এখনও কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি।’
আর, কোনো খাবারে টেস্টিং-সল্ট আছে কি না, সেটি একটু খেয়াল করলেই বোঝা সম্ভব। এসব খাবার মুখে দিলেই একটা ঝাঁঝালো নোনা স্বাদ পাওয়া যায়। ওটা টেস্টিং-সল্টেরই ‘কৃতিত্ব’। এটি ছেলে-বুড়ো সবার কাছেই বেশ সুস্বাদু ঠেকে, তাই এসব খাবার খেতে মন চায় বার বার।
‘আপনার স্বাস্থ্যে এমএসজি প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে ভারতের বিশিষ্ট স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞ উমা শংকরী বলেন, টেস্টিং-সল্ট স্নায়ুকোষকে হত্যা করে। যেসব খাদ্যে অধিক পরিমাণ টেস্টিং-সল্ট রয়েছে সেগুলো ভোক্তাদের মাঝে মাদকের মতো আসক্তি ও নেশার সৃষ্টি করে। তাই মানুষ এগুলো বার বার খেতে চায়। তার মতে, কম চর্বিযুক্ত খাবার তেমন সুস্বাদু নয় বলে তা মানুষকে খুব বেশি আকৃষ্ট করে না, কিন্তু তাতে যদি টেস্টিং-সল্ট মেশানো হয় তবে খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি পায়। যা হয়তো তৃপ্তিদায়ক, কিন্তু ক্ষতিকর।
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য খাদ্যপণ্য কেনার সময় প্যাকেটের গায়ে ভালোভাবে এর উপাদানগুলো দেখে নিন-তাতে টেস্টিং-সল্টের উল্লেখ আছে কি না। বিশ্বব্যাপী সচেতনতা গড়ে ওঠার পর থেকে খাদ্য-প্রস্তুতকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তাদের বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের প্যাকেটের গায়ে সরাসরি ‘টেস্টিং-সল্ট’ শব্দটি উল্লেখ করছে না। তার পরিবর্তে লেখা থাকে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট কিংবা আরো সংক্ষেপে এমএসজি। আসলে জিনিস একই।
বিশ শতকের শুরুর দিকে ১৯০৮ সালে জাপানি রসায়নবিদ ও টোকিও ইমপেরিয়াল ইউনিভার্সিটির গবেষক কিকুনেই ইকেদা এটি উদ্ভাবন করেন। তখন এটি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে খাবার-সুগন্ধকারী উপাদান হিসেবে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে অনেকগুলো গবেষণায় ক্রমেই এর স্বাস্থ্যহানিকর দিকটি সচেতন বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন।
বাংলা৭১নিউজ/এমএস