ওপেকের (অর্গাইনাজেশন অব দ্য পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ) সদস্যসংখ্যা ১৩টি তেলসমৃদ্ধ দেশ। এই দেশগুলোর অবস্হান মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে। ওপেক পৃথিবীর মোট তেল উৎপাদনের ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিশ্বের তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণের নাটাই বলতে গেলে তাদেরই হাতে। ফলে জেরাল্ড ফোর্ড থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টগণ তেলের দাম নিয়ন্ত্রণকারী এই জোটকে মার্কিন অর্থনীতির জন্য হুমকি মনে করেছেন এবং বিভিন্ন সময় মূল্যবৃদ্ধির জন্য তাদের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওপেকের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে এর সদস্যদের মধ্যে বিভক্তি, প্রধান তেল রপ্তানিকারক হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উৎথান এবং ক্লিনার এনার্জির উৎসগুলোতে বৈশ্বিক স্হানান্তর।
এই প্রেক্ষাপটে জোটটি রাশিয়া এবং অন্যান্য দেশকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করেছে ওপেক প্লাস। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারি ওপেক প্লাসের প্রচেষ্টাগুলোকে দুর্বল করেছে। এ বছর ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওপেক নতুন করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
১৯৬০ সালে ইরান, ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব ও ভেনিজুয়েলাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ওপেক। বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে এই দেশগুলো তেলের দাম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রসহ তেল আমদানিকারক পশ্চিমা বিশ্বের তেলের বাজারের নিয়ন্ত্রকও তারা। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো জাতীয়করণের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব সম্পদের ওপর বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকারীও তারা। এ কারণে বেশির ভাগ ওপেক দেশ এখন তাদের সমস্ত তেলের রিজার্ভের মালিক।
বর্তমানে ওপেকভুক্ত দেশগুলো হলো—ইরাক, ইরান, আলজেরিয়া, লিবিয়া, কুয়েত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নাইজেরিয়া, ভেনিজুয়েলা, গিনি, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, গ্যাবন, অ্যাঙ্গোলা। সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিয়মিত ও জরুরি বৈঠক করে সারা বিশ্বে তেলের দাম ও উৎপাদন স্তরের নীতিগুলো সমন্বয় করে। ওপেকের সদর দপ্তর ভিয়েনা। ওপেকের প্রতিনিধিত্ব সাধারণত প্রতিটি সদস্য দেশের তেলমন্ত্রীদের নেতৃত্বে থাকে এবং একজন সেক্রেটারি জেনারেল এই সংস্হার দৈনন্দিন ব্যবস্হাপনার দায়িত্বে রয়েছেন।
বিশ্বমঞ্চে ওপেকের প্রভাব বিস্তার শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। এই বছরের শেষের দিকে মিশর ও সিরিয়া আকস্মিকভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলিদের জন্য ২.২ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে। আরব তেলমন্ত্রীদের নেতৃত্বে ওপেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের অন্যান্য মিত্রদের বিরুদ্ধে তেল নিষেধাজ্ঞা দেয় এবং তেলের উৎপাদন কমাতে শুরু করে।
এতে ভোক্তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তেলের বাজারে বাড়তে থাকে দাম। এই পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তেলের মূল্য নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তড়িঘড়ি করে যুদ্ধের অবসান ও ওপেকের নিষেধাজ্ঞার জন্য আলাপ-আলোচনা শুরু করেন।
প্রথম দিকে ওপেক ব্যাপক মুনাফা লাভ করে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে এই মুনাফা ২৩ বিলিয়ন থেকে ১৪০ বিলিয়ন ডলারে উপনীত হয়। এদিকে পশ্চিমা বিশ্বে তেলের চড়া মূল্যের কারণে মন্দার সৃষ্টি হয়। মার্কিন মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ৬ শতাংশ হ্রাস পায়।
বেকারত্ব বেড়ে দ্বিগুণ হয়। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের (সিএফআর) সাবেক সিনিয়র ফেলো অ্যামি মায়ার্স জাফ এবং অর্থনীতিবিদ অ্যাডওয়ার্ড মোর্স সে সময় লিখেছিলেন, ‘ওপেকের নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বকে নতজানু করার জন্য তৃতীয় বিশ্বের শক্তির এটাই প্রথম বড় বিজয়’।
অবশ্য এখন বিভক্তির কারণে ওপেকের শক্তি হ্রাস পেয়েছে। এর কারণ আঞ্চলিক ক্ষমতার লড়াই। আশির দশকে ইরান, সাদ্দাম হোসেনের ইরাক ও গাদ্দাফির লিবিয়া ওপেক সদস্য হলে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েতের সঙ্গে তাদের নানা বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়।
ওপেক সদস্যদের মধ্যে কলহ মাঝেমধ্যে দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, আট বছরব্যাপী ইরান ও ইরাক যুদ্ধের কারণে লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়। এই সময় যদিও ইরাককে সাহাঘ্য করার জন্য তেলের দাম কৃত্রিমভাবে কম রাখার ব্যাপারে ইরান আরব প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়ন করে, তথাপি ইরাক বা ইরান কেউই ওপেক ত্যাগ করেনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড্রানিয়েল এইচ ইয়েরগিনের মতে, ওপেকের সর্বকালের সবচেয়ে খারাপ সংকট ছিল ১৯৯০ সালে ইরাকের কুয়েতে আক্রমণের সময়। যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজার থেকে ৪ মিলিয়ন ব্যারেল তেল সরিয়ে নেওয়া হয়। এতে তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। অন্য সদস্য দেশগুলো তখন আশঙ্কা করেছিল যে ইরাক শিগ্গিরই সৌদি আরব আক্রমণ করবে। এ সময় অন্য ওপেক সদস্যরা যুদ্ধের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তেল উৎপাদনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন যে, সৌদি আরব ওপেকের সামগ্রিক অপরিশোধিত তেলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন করে। সেই কারণে সৌদি নেতৃত্ব তেল কূটনীতির মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর ২০১৫ সালের চুক্তি থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রত্যাহারকে সম্ভব করে তুলেছিল এবং ইরানের তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনরায় আরোপ করতে সক্ষম হয়েছিল। জো বাইডেন প্রশাসন পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করতে এবং সেই নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নিতে তেহরানের সঙ্গে এখন আলোচনা করছে। এক অর্থনৈতিক গবেষণায় দেখা যায় যে, ওপেক না থাকলে তেলের দাম কম হতো।
১৯৭৩ সাল থেকে ওপেকের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক শিথিল রয়েছে। নিক্সনের পর থেকে প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্টই স্বাধীন জ্বালানির পক্ষে কথা বলেছেন। যদিও অর্থনীতিবিদরা এই ধরনের লক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন যে, এর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্তত মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার মনোযোগ সরাতে পারবে। এর বিকল্প হিসেবে রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার আমেরিকানদের জ্বালানি খরচ কমাতে উৎসাহিত করেন।
কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতিতে অবদান রাখছে তেলের মূল্য বৃদ্ধি। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার এক প্রতিক্রিয়ায় এজন্য ওপেককে দায়ী করেছেন। কেননা তারা যথেষ্ট ও দ্রুত তেলের উৎপাদন বাড়াচ্ছে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক কালে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে এবং ২০১৯ সালে ওপেক রাশিয়া ও অন্যান্য তেল রপ্তানিকারক দেশকে নিয়ে গঠন করেছে ওপেক প্লাস।
ফলে বিশ্বের তেলবাজারে রাশিয়ার প্রভাব বেড়েছে। ওপেকের জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা ও একে ঘিরে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে এর প্রভাব-বলয় বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে ওপেককে একটি রাজনৈতিক ক্লাব হিসেবে অভিহিত করছেন।
ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে ওপেক আবার নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে। বাইডেন রাশিয়ার তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরশলতা কমাবার কথা বলছে। এ কারণে ২০০৮ সালের পর জ্বালানি তেলের দাম এখন সর্বোচ্চ। ব্যারেলপ্রতি ১৩০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এজন্য অনেক রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতা এখন নতুন করে তেলের খনি অনুসন্ধানে খননকাজের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ:
ফাইজুল ইসলাম
লেখকদ্বয়: যথাক্রমে সিএফআরের অর্থনীতি, জ্বালানি ও ভূরাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
বাংলা৭১নিউজ/এসএম