ইরানের সাধারণ মানুষের মধ্যে চীন-বিরোধি মনোভাব ক্রমে তীব্র হয়ে উঠছে। সম্প্রতি দেশটিতে সৃষ্ট ব্যাপক হারে বিদ্যুত ঘাটতির পেছনেও চীনকে দায়ি করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকা চীনের বিটকয়েন কোম্পানিগুলোর কারণেই বিদ্যুতের এ সংকট। ফ্রান্সের একটি গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
জানুয়ারির শেষের দিক থেকে ইরানের কয়েক ডজন শহরে ঘনঘন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার মতো ঘটনা শুরু হয়। বিটকয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রা লেনদেন কোম্পানিগুলো পরিচালনার জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ হওয়ার কারণেই দেশজুড়ে এই বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা দেয় বলে জানা গেছে। দেশটির জ্বালানী মন্ত্রী রেজা আর্দেকানিয়ানও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে এ সব বিটকয়েন কোম্পানির একটি বড় অংশ যে চীনের তা মন্ত্রী স্বীকার করেননি।
প্যারিসভিত্তিক রাষ্ট্রমালিকানাধীন আন্তর্জাতিক নিউজ টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ফ্রান্স টুয়েন্টিফোরের ‘ফ্রান্স২৪ অবজার্ভার টিমের’ এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে যে ইরানের বিদ্যুৎ ঘাটতির পেছনে চীনের বিটকয়েন কোম্পানিগুলোই দায়ি। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি ‘ইরানে বিদ্যুৎ ঘাটতি, চীনা বিটকয়েন কোম্পানির গোপন ব্যবসার তথ্যফাঁস’ এই শিরোনামে প্রকাশ হয়েছে।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি তৈরি করতে ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলের বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার সাক্ষাতকার নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কেরমান প্রদেশে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাফসানজান শহরের কাছেই থাকা একটি বিটকয়েন কোম্পানির জন্য প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তথ্যানুযায়ী, এটি ইরানে বৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনাকারী বৃহত্তম বিটকয়েন কোম্পানি।
চীনের বিটকয়েন কোম্পানি আরএইচওয়াই ইরানে ব্যবসা পরিচালনা করলেও এখানে নিজেদের কার্যক্রম নিয়ে যথাসম্ভব সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ‘ফ্রান্স২৪ অবজার্ভার টিম’কে কোম্পানিটি জানায়, বিটকয়েন ব্যবসায়ীদের জন্য জায়গাটি ‘স্বর্গসম।’ তবে এই ‘জায়গা’ বলতে কোম্পানিটি একবারের জন্য হলেও ‘ইরানের’ নাম উচ্চারণ করেনি। বরং এর পরিবর্তে তারা ‘মধ্যপ্রাচ্য’ উল্লেখ করেছে।
প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, চীনের অনেক কোম্পানিই ইরানে প্রচ্ছন্নভাবে ব্যবসা করার সুযোগটি হাতছাড়া করতে চায়নি। দেশটি থেকে বিটকয়েন তৈরির জন্য তারা অনেক অর্থ বিনিয়োগ করেছে। তবে এসব কোম্পানি এখানে দুটি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। প্রথম সমস্যা বিদ্যুতের ব্যাপক ঘাটতি এবং দ্বিতীয় সমস্যা ইরানের জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান চীন বিরোধি মনোভাব।
ইরানে বর্তমানে কমপক্ষে ১৪টি বৈধ বিটকয়েন কোম্পানি আছে বলে নিশ্চিত করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। এসব কোম্পানির জন্য মোট ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। এক লাখ বাসিন্দার কোনো শহরের জন্য একই পরিমাণে বিদ্যুৎ লাগে বলে ফ্রান্স২৪ এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তবে এসব বিটকয়েন কোম্পানির জন্য প্রায় ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয় বলেও জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।
আর এসব দিক বিবেচনা করলে ইরানিদের মধ্যে চীন-বিরোধি মনোভাব সৃষ্টি হওয়া বিস্ময়কর কিছু নয়। গত ১১ জানুয়ারি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ইরানে একটি বিটকয়েন কোম্পানিতে একজন চীনা কর্মী বিভিন্ন ধাপ প্রদর্শন করছেন। ফ্রান্স২৪ অবজার্ভার টিমের অনুসন্ধানে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় ইরানে মাকু অঞ্চলে মানা পারদাজেশ এশিয়া নামে আরেকটি বিটকয়েন কোম্পানির হদিস পাওয়া যায়।
একদিকে নিজেরা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না, অন্যদিকে চীনা বিটকয়েন কোম্পানি ব্যাপক হারে বিদ্যুতের ব্যবহার করছে। আর এ বিষয়টি নিয়ে ইরানের সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ক্রমে বড় আকার ধারণ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় তাদের এ ক্ষোভের রেশ ছড়িয়ে পড়ছে। হ্যাসট্যাগ #চায়নালাইডমিলিয়নসডাইড লিখে একজন টুইটারে জানান, ‘সামাজিক মাধ্যম তাদের কাজ করেছে। এখন সিংহভাগ মানুষ জানে যে চীনের বিটকয়েন খনন কাজের জন্যই এই বিদ্যুৎ ঘাটতি। আর এ কারণে আমাদের না আছে বিদ্যুৎ, না আছে ব্যবসা।’
ইরানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক এহসান সুলতানি বলেন, ‘ইরান এখন আর অসহায় নয়। ইরানের বিদ্যুৎ এখন তারা বিটকয়েন তৈরির কাজে ব্যবহার করছে। তাদের ট্রলারের কারণে পারস্য উপসাগরে স্থানীয় মৎসশিকার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।যারা একসময় চীনের নামে বিক্ষোভ করতেন তারাই এখন দেশকে বেইজিংয়ের কাছে উপহার হিসেবে তুলে ধরেছে।’
তবে বিদ্যুৎ ঘাটতির বিষয়টি অহেতুক বলে উড়িয়ে দিয়েছেন ইরান-চীনের যৌথ চেম্বার অব কমার্সের প্রধান মজিদ রেজা হারিরি। তিনি বিশ্বাস করেন তেহরান-বেইজিং বাণিজ্য সম্পর্ক বর্ধনের বিপক্ষে থাকা ব্যাক্তিরাই উত্তেজনা উসকে দিচ্ছে।
বাংলা৭১নিউজ/এএস