বাংলা৭১নিউজ ডেস্ক: লালু গ্রামের ছেলে। দেশে যখন যুদ্ধ শুরু হলো, সে আর ঘরে থাকতে পারল না। বেরিয়ে পড়ল। বড়রা তাকে ডাকে। কেউ আবার হাসাহাসি করে। হাতের ইশারায় দেখিয়ে বলে, এই একরত্তি ছেলে করবে যুদ্ধ? হাতে নেবে বন্দুক? ছুড়ে মারবে গ্রেনেড? আরও কত কথা! লালুর মন নেই ওসবে। সে যুদ্ধে যাবে তো যাবেই। কারও কটু কথা তাকে পিছু হটাতে পারে না। মা-বাবাও নেই যে পেছন ফিরে তাকাবে। একরোখা লালু যুদ্ধের পথে নেমেছে তো নেমেছেই। বড়দের যেখানে বুক কাঁপে, লালু সেখানে ডর-ভয় তোয়াক্কা না করে চলে যায়। এইভাবে খুঁজে বের করে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। ১২-১৩ বছরের ছেলেটা ক্যাম্পে ঢুকেই চলে যায় কমান্ডারের সামনে। বুক ফুলিয়ে বলে, ‘আমি যুদ্ধ করব।’
এইটুকুন ছেলের মুখে এমন কথা শুনে ক্যাম্পের অনেকে হেসে ফেলল। কিন্তু কমান্ডার হাসলেন না। তিনি কিছুটা অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘তুমি তো বন্দুক আলগাইতে পারবা না, কী যুদ্ধ করবা খোকা? যাও, বাড়ি যাও। বড় হইলে যুদ্ধ কইরো।’
‘আমি ছোট বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করব।’ এই বলে লালু কান্নাকাটি শুরু করল। কমান্ডার তার গায়ে হাত রাখলেন। লালু ফের বলে ওঠে, ‘আমি যুদ্ধে যাব। আর দেশ স্বাধীন করেই বাড়ি ফিরব।’
কমান্ডার আবারও বললেন বাড়ি চলে যেতে। কিন্তু না, লালু তার সিদ্ধান্তে অটল। অবশেষে তাকে রেখে দেওয়া হয় ক্যাম্পে। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে লালু। সে এখন যোদ্ধা! ক্যাম্পে সে ফুটফরমাশ খাটে। অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করে। তবে এসবে মন নেই তার। কীভাবে থাকবে? সে তো যুদ্ধ করতে এসেছে এখানে! দেশ স্বাধীন করতে এসেছে। সে তার কাজ সেরে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ে হাজির হয়ে যায়। কখনো আবার কাজের ফাঁকেই অনুনয়-বিনয় করে যুদ্ধের কৌশল শেখে। অল্প দিনেই লালু শিখে যায়—কীভাবে হামাগুড়ি দিতে হয়, কীভাবে অস্ত্র চালাতে হয়, গ্রেনেড ছুড়তে হয়, নিতে হয় শত্রুর গতিবিধির খবর। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ছোট্টমোট্ট লালু বড়দের কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে একদিন যুদ্ধেও নেমে পড়ে। জমে ওঠে যুদ্ধ।
চারদিকে গোলাগুলির শব্দ। মানুষের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানিরা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে গুলি করে মারছে। বাঙালিরা ভয়ে শহর থেকে গ্রামে; এ-গ্রাম থেকে ও-গ্রাম পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে লালু শিখে ফেলেছে যুদ্ধের নানা কৌশল। ক্যাম্পের সবাই ছোট্ট লালুকে নিজেদের মতোই যোদ্ধা মনে করে। কমান্ডার আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি একদিন লালুকে বললেন, ‘ওই যে দূরে গোপালপুর থানা দেখছ, জায়গাটা একবার ঘুরে দেখে আসো।’
লালু তো কমান্ডারের অর্ডারের অপেক্ষাতেই ছিল। বুক ফুলিয়ে চলে গেল পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে। পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে ঢুকতেই এলাকার এক বড় ভাইয়ের দেখা পায় লালু। লোকটার নাম সিরাজ। সে ছিল রাজাকার। পাকিস্তানিদের হয়ে কাজ করছে। লালু গ্রামের সিরাজ ভাইকে দেখেই তাকে জড়িয়ে ধরে। এটাও তার একটা কৌশল বটে! লোকটাকে সে কিচ্ছু বুঝতে দেয় না। সিরাজ লালুকে পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে কাজ করতে বলে। বুদ্ধিমান লালুও নিজের পরিচয় গোপন করে সিরাজ ভাইয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী তাকে দিয়ে ক্যাম্পে নানা ফুটফরমাশ খাটাতে শুরু করে। কয়েক দিনের মাথায় লালু তাদের আস্থা অর্জন করে নেয়।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা লালুর অপেক্ষায় থাকেন। ছোট্ট লালুও একটু ফাঁকফোকর পেলেই মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে চলে আসে। সব তথ্য জানিয়ে যায়। লালুর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে ১৯৭১ সালের ৭ অক্টোবর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায় গোপালপুর থানার পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে। ৮ অক্টোবর পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়েও থানাটি দখল করতে পারছিল না মুক্তিবাহিনী।
এর মধ্যে একদিন লালু লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প থেকে তিনটি গ্রেনেড নিয়ে হাজির হয় পাকিস্তানি ক্যাম্পে। পুরো পুলিশ স্টেশন চক্কর মেরে, মাথা খাটিয়ে সে টার্গেট ঠিক করে। তারপর চুপিচুপি গ্রেনেড বের করে। প্রথম গ্রেনেডটা বাঙ্কারের দিকে ছুড়ে মারে, যেখান থেকে অস্ত্র চালায় পাকিস্তানি সেনারা। গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতেই পাকিস্তানিরা ভয় পেয়ে যায়। ভয় পেয়ে অন্য বাংকারে থাকা সৈন্যরাও এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে।
অবস্থা বেগতিক দেখে সাহসী লালু শুয়ে পড়ে। তবে একটুও দমে না। শুয়ে শুয়েই সে দ্বিতীয় গ্রেনেডটা ছুড়ে দেয়। কিন্তু সেটা বিস্ফোরিত হয় না। ঘাবড়ায় না লালু। ছুড়ে দেয় তৃতীয় গ্রেনেড। সেটা সশব্দে বিস্ফোরিত হয়। এবার আর ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পায় না পাকিস্তানি বাহিনী। তারা ভাবতেই পারেনি ছোট্ট লালু এমন দুঃসাহসিক হামলা চালিয়ে বসবে তাদের ওপর। লালুর এই হামলায় গোপালপুর থানায় উড়ে এসে জুড়ে বসা পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী আটজন নিহত হয়। আহত হয় অনেক। শুধু তাই নয়, ভয়ে পাকিস্তানিরা গোপালপুর ছেড়ে পালিয়ে যায়।
জয় আসে মুক্তিযোদ্ধাদের। লালুকে কোলে-পিঠে নিয়ে আনন্দ মিছিল বের হয়। এই জয়ই শেষ নয়; পিচ্চি লালু গোপালপুর ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অপারেশনে চলে যায় দূর-দূরান্তে। গেরিলা যুদ্ধও শিখে নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা তার কায়দাকানুন দেখে অবাক হয়। বলে, ‘ও লালু, কোত্থেকে শিখলি রে এসব?’
লালু কথা বলে না। শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর নতুন অপারেশনের কথা ভাবে। একসময় যুদ্ধ থামে। দেশ স্বাধীন হয়। তার বীরত্বের কথা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণের এক অনুষ্ঠানে পিচ্চি লালুর বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের বিবরণ শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে তাকে কোলে তুলে নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আদর করে লালুর নাম দেন, ‘বীর বিচ্ছু লালু’। এই বিচ্ছু লালুর আসল নাম শহীদুল ইসলাম। যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে তাকে বীর প্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। ২০০৯ সালের মে মাস পর্যন্ত লালু কাটিয়েছেন ঢাকার মিরপুর চিড়িয়াখানা-সংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে। সেখানেই ছিল তাঁর বাসা। এখানে কেটেছে তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো। ২০০৯ সালের ২৫ মে বীর মুক্তিযোদ্ধা লালু আকাশের দেশে চলে যান। গভীর রাতে আকাশে মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা যে তারাটা দেখবে, ভাববে, সেটাই আমাদের সাহসী লালু। সেটাই আমাদের বীর বিচ্ছু!
লেখক: আশিক মুস্তাফা
বাংলা৭১নিউজ/সিএইস