বাংলা৭১নিউজ, এম.নাজিম উদ্দিন,পটুয়াখালী প্রতিনিধি: এ কোন রুপ কথা নয়। ইতিহাসের এক বাস্তব প্রতিফলন। যা দেখতে হলে ঘুরে আসতে পারেন পটুয়াখালীর বাউফলে। উপজেলার কাছিপাড়া ইউনিয়নে অবস্থিত এ বলাই কানাই দিঘি। বাউফলে ঐতিহাসিক দুইটি দিঘী রয়েছে। একটি কমলা রানীর দিঘী (কালাইয়া ইউনিয়নে) অপরটি বলাই কানাই দিঘী( কাছিপাড়া ইউনিয়নে)। তার মধ্যে কমলা রানীর দিঘীর অস্তিত্ব প্রায় বিলীন। কিন্তু বলাই কানাই দিঘীটি এখনো টিকে আছে। কিন্তু খননের পর থেকে অদ্যবধি এই দিঘীটি সংস্কারের কোন উদ্যোগ কেউ নেয়নি। ফলে কচুরিপানা, আগাছা ও হরেকরকম লতাপাতা জন্মে দিঘীটি মৃতপ্রায়। তাই বাউফল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান দিঘীটির সংস্কারের শুভ উদ্ভোধন করেন। ৩ শতাধিক বছর পূর্বে (মুঘল /নবাব আমলে) এলাকার লোকজনের বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করার জন্য এই দিঘী খনন করা হয়েছিল। সেই থেকে দিঘীটি এলাকার লোকজনের বিশুদ্ধ পানীয় জলের যোগান দিয়ে আসছিল। তখনও দিঘীটির কোন নির্দিষ্ট নাম ছিলনা। প্রায় শতাধিক বছর পূর্বে এই দিঘীর পাড়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কানাই ও বলাই নামে দুই ভাই বসবাস করত। এরা প্রতিদিন এই দিঘীতে স্নান করে পার্শবর্তী হিন্দুপাড়ায় নাম কীর্তন করতে যেত। প্রতিদিনের মতো ওইদিন সকালেও এরা স্নানের উদ্দেশ্যে দিঘীর ঘাটে নামে। ঘাটে তখন দুটি বিশাল আকৃতির গজাল মাছ শুয়ে ছিল। দুই ভাই এগুলোকে খেজুর গাছের খন্ড ভেবে এগুলোতে বসেই স্নান করতে থাকে। এক পর্যায়ে শরীরে সাবান মাখার সময় সাবান জলের ঝাঁঝে মাছের ঘুম ভেঙে যায় এবং দুই ভাইকে নিয়ে মাছদুটো দিঘীর তলদেশে হারিয়ে যায়। কানাই বলাই আর কখনো ফিরে আসেনি। সেই থেকে এই দিঘীটি বলাই কানাই দিঘী নামে পরিচিতি লাভ করে। এই দিঘী নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে আরো অনেক কথা বৃদ্ধমান রয়েছে। ২০/২২ বছর পুর্বে স্থানীয় কাছিপাড়া হাইস্কুলের এক ছাত্র দিঘীতে ডুব দেয়। সে জলের নিচে কি যেন দেখতে পায়। জলের তলদেশ থেকে কে যেন তাকে নিষেধ করে দেয় যা দেখেছে তা যেন উপরে উঠে না বলে। কিন্তু ছেলেটি এসে বলে দেয়ায় তক্ষুনি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়। ১৫/১৬ বছর পূর্বে মাধবপুর গ্রামের এক মহিলা এই দিঘীতে কি আছে তা পরীক্ষা করার জন্য ডুব দেয়। চারদিন পর তার লাশ দিঘীর জলে ভেসে উঠে।
এছাড়াও স্থানীয় লোকজনের মনে এই দিঘী ঘিরে রয়েছে আরো নানান রহস্যজনক কথা। কেউ মনে করেন এই দিঘীর কোন তলদেশ নেই। কতটুকু গভীরতা কেউ বলতে পারেননা। কেউ কেউ মনে করেন এই দিঘীর জলে রয়েছে সোনার হাড়ি পাতিল ইত্যাদি। প্রতিবছর ০৯,১০,১১ ই ফালগুন ওই দিঘির পাড়ে উরুছ হয়। এ সময় হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী দূর দূরান্ত থেকে এই দিঘীর জলে স্নান করতে আসেন। এমনকি অনেক মুসলমান লোকজনও আসেন গোসল করতে। তাদের বিশ্বাস এই দিঘীর পানিতে স্নান করলে দেহমন পবিত্র হয়, মানত করলে মনোবাসনা পূরণ হয়। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মানুষ আসে মনোবাসনা পূরণের লক্ষ্যে, দিঘীর জলে দুধ, কলা, সিঁদুর দিতে ও স্নান করতে। বিশ্বাস, ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিয়ে হাজারো মানুষ শতাধিক বছর ধরে বলাই কানাই দিঘীতে আসেন মুক্তিলাভের আশায়। এই দিঘীটি আরেকটি বিশেষ কারনে তাৎপর্যপূর্ণ। এই দিঘীর পাড়ে অযতেœ অবহেলায় ঘুমিয়ে আছে ২০০১ সালের রমনার বটমূলে ঘাতকের বোমা হামলায় নিহত একই পরিবারের তিন ভাইবোন: মামুন, রিয়াজ ও শিল্পী। তাঁদের কবরগুলোও সংস্কারের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু খননের পর থেকে অদ্যবধি এই দিঘীটি সংস্কারের কোন উদ্যোগ কেউ নেয়নি। ফলে কচুরিপানা, আগাছা ও হরেকরকম লতা জন্মে দিঘীটি মৃতপ্রায়। জঙ্গলের গভীরতা এত বিশাল হয়ে গেছে যে এগুলোর উপর দিয়ে হেঁটে অনায়াসে যাতায়াত করা যায়। স্থানীয় বাসিন্দা দরবেশ মো: আবদুল মান্নান তার প্রতক্রিয়ায় বলেন, আমার বয়স একশত বছরের অধিক। আমি আমার বাবা দাদার মুখেও এই দিঘীর গল্প শুনেছি। টিএনও(তাঁর ভাষায়) সাব এই দিঘী সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ায় আমি খুব আনন্দিত। আমি টিএনও সাবের জন্য প্রানখুলে দোয়া করি।
বাউফল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন,দিঘীটি সরেজমিনে দেখে ও এর উপরোক্ত বিশেষত্ব জেনে আমার মনে হয়েছে এই ঐতিহাসিক স্থানটি আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। গতকাল ০৯ ডিসেম্বর ২০১৭ রবিবার কাছিপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব রফিক সাহেব, ইউপি মেম্বারগণ, প্রামপুলিশবৃন্দ, স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সামছুল আলম মিয়া, পিআইও রাজিব বিশ্বাসসহ প্রায় শতাধিক লোকের উপস্থিতিতে ঐতিহাসিক বলাই কানাই দিঘীর সংস্কার কাজের শুভ উদ্ভোধন করি। আশা করি সকলের সহযোগিতায় ঐতিহাসিক এই দিঘীটি সংস্কারের কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন হবে, পূর্ণার্থীদের জন্য শেড নির্মাণ হবে,একটি ঘাট নির্মিত হবে। শত শত দর্শনার্থীর ভীড়ে মুখরিত হয়ে উঠবে বলাই কানাই দিঘীটি। উজ্জ্বল হবে কাছিপাড়া তথা বাউফলের মুখ।
বাংলা৭১নিউজ/জেএস